#THE_BOOK
#পর্ব_১০,১১
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
১০
সকালের বাতাসটা লাবন্যর গা ছুঁয়ে দিচ্ছে।মন্দ লাগছে না লাবন্যর। কফির কাপ হাতে জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘনঘন কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে সে। সকালেই প্রিতমের সাথে কথা হয়েছে। খুব শীঘ্রই ওদের বিয়েটা হবে এই মাসে প্রিতমের অফিসের চাপটা একটু বেশি তাই পরের মাসে বিয়ের কথাবার্তা বলতে লাবন্যর বাড়িতে যাবে। এটা ভেবে লাবন্যর খুশি লাগছে খুব। এসব ভাবতে ভাবতে সময় অনেকটা পেরিয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে উঠে লাবন্যর। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো।
আজকে রেডিও স্টেশনে যেতে দেরি হয়ে গেছে লাবন্যর। অভিনব আর রা’দ আগেই চলে এসেছে। পূর্ণাশা আসেনি কারণ ও এই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ছোটখাটো একটা প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি নিয়েছে।সামির রায়হান পড়েছে বিপাকে। ওনার রেডিও স্টেশন যে ডুবতে বসেছে। রা’দ অভিনব আর লাবন্য ও তো ছেড়ে দেবে। তাহলে ওনার চলবে কিভাবে??তাই তিনি প্রতিদিন ওদের কিছু কিছু বুঝাচ্ছে যাতে ওরা চাকরি না ছাড়ে।
লাবন্য তড়িঘড়ি করে অফিসে ঢুকলো। নিজের ডেস্কে বসতে বসতে অভিনবের দিকে তাকালো। অভিনব অন্যমনস্ক হয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।লাবন্য অভিনবকে বলল,”হোয়াট হ্যাপেন্ড অভিনব??”
লাবন্যর দিকে তাকিয়ে অভিনব মাথা নাড়ায় কিন্তু মুখে কিছু বলে না। লাবন্য বলল,”তুই কি কোনো বিষয়ে আপসেট?? হসপিটাল থেকে ফিরে আসার পর থেকে তুই যেন কেমন হয়ে গিয়েছিস প্লিজ কিছু তো বল??”
অভিনব বড় একটা শ্বাস ফেলে। রা’দ এসে ওর পাশে বসে বলল,”তোর আপসেটের কারণ কি মারমেইড??”
লাবন্য অবাক হয়ে বলল,”জলপরী?? অভিনব তখন তুই অসুস্থ ছিলি আর ওই জলপরী তোর ব্রেণ ওয়াশ করে দিয়েছিলো যার কারণে তুই প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলি। জলপরী তোকে ভালোবাসতো না এটা ওর ফাঁদ ছিলো। কিন্তু এখন তো তুই সুস্থ তাহলে?? এখন তো সব বুঝতে পেরছিস তাহলে এসব ব্যাপার নিয়ে আপসেট হচ্ছিস কেন??”
অভিনব দৃষ্টি নিচু করে বলল,”কিন্তু আমার অনুভূতি তো শূন্য ছিলো না। আমার ভালোবাসা তো মিথ্যা ছিল না। আমার পাগলামো গুলো কি শুধুই ওই বইয়ের লেখাগুলো পূরণ করার জন্য ছিলো?? ভালোবাসা কি ছিলোই না??? তখন আমি বুঝতে পারিনি যে কোনটা করলে আমার ভালো হবে কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। তবুও আমার মন মানছে না। আমার সাথেই এটা কেন হতে হলো?? মিথ্যা ভালোবাসার জালে জড়িয়ে আমি তাকে সত্যি ভালোবেসে ফেললাম কেন?? এখন কিছুতেই তার প্রতি আমার অনুভূতি শূন্য হচ্ছে না। আমি পারছি না তাকে ভুলতে। চোখ বন্ধ করলে ওর মুখটা কেনো ভেসে আসে?? আমি ওকে ভুলতে পারছি না। কোনদিন পারব ও না। এজন্য আমি তোদের দোষ দিচ্ছি না। তোরা আমার ভালোর জন্যই এসব করেছিস কিন্তু তবুও আমার ভালো লাগছে না।”
রা’দ আর লাবন্য অভিনবের দিকে তাকিয়ে আছে। অভিনব এখনও জলপরীকেই ভালোবাসে। কিন্তু অভিনব এটা জানে না যে এতদিনে মিথ্যা ভালোবাসার নাটক করতে করতে জলপরীর মনেও ওর জন্য কিছু অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। এসব বললে হয়তো অভিনব আরো কষ্ট পাবে তাই রা’দ অভিনবকে এসব বিষয়ে কিছু বলল না।অভিনবের কাঁধে হাত রেখে বলল,”এসব যত তাড়াতাড়ি ভুলবি ততই ভালো। সামনে আমাদের আরও অনেক বড় লড়াই আছে।সেই লড়াইতে তোর হাত লাগবে আমাদের। তুই থাকবি না??”
অভিনব রা’দের হাতে হাত রেখে বলল,” আমি সবসময়ই তোদের পাশে আছি। আমৃত্যু পর্যন্ত থাকবো।”
লাবন্য বলল,”তাহলে এবার তো একটু হাসি দে। তোর এই গোমড়া মুখ দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না।”
অভিনব জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। রা’দ আর লাবন্য তাতে উৎসাহ দিলো।
কিন্তু ওরা এখন পূর্ণাশাকে মিস করছে। চারবন্ধু এতদিন একসাথে ছিলো। হাসি খেলা আড্ডার মধ্যে দিয়েই ওদের জীবন কেটেছে কিন্তু এখন ওদের মধ্যে একজন নেই। এভাবেই কি কোন একদিন চারবন্ধু চার দিকে চলে যাবে?? হারিয়ে যাবে তাদের বন্ধুত্ব??নাকি কোন একদিন ফিরে আসবে সবাই?? আবার একসঙ্গে মজ করে দিন কাটবে সবার??
সন্ধ্যার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় পূর্ণাশা।ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে সে। আজকে বসের একগাদা ঝাড়ি খেয়েছে। তাই মনটা খারাপ হয়ে আছে। পূর্ণাশা তো এসব কাজ কখনোই করেনি। ভুত প্রেতের আড্ডায় মেতে থাকতো সবসময়। এসব চাকরি বাকরি কি ও করেছে কখনো??একরাশ বিরক্তি নিয়ে যাত্রি ছাউনীতে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণাশা। এই বাসটাও আসছে না। বিরক্তি আরো এসে পড়লো পূর্ণাশার। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস চলে আসলো। জানালার পাশের সিটটাতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। সিটের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসলো। বাড়িতে ফিরে তাড়াতাড়ি গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো। এতক্ষণে পূর্ণাশার মনটা শান্ত হলো।ক্লান্তিগুলো ও যেন উড়ে গেল। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে পূর্ণাশা যেন সবকিছু ভুলেই গিয়েছে। কলিং বেলের শব্দে পূর্ণাশার ধ্যান ভাঙলো। কিন্তু পূর্ণাশা তো এখনও ভিজতেছে। তড়িঘড়ি করে শাওয়ার বন্ধ করে চেঞ্জ করতে লাগলো। ওদিকে কলিং বেল অনবরত বেজেই যাচ্ছে। কোনরকমে চেঞ্জ করে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলে একদফা অবাক হয় পূর্ণাশা। ওর বন্ধুমহলের বাকি তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। বেশি অবাক হয়েছে অভিনবকে দেখে। কারণ অভিনব এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। ফোন করলে রিসিভ করে না। রিসিভ করলে ঠিকমতো কথা বলে না। আর সেই অভিনব ওর বাসায়!!পূর্ণাশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভিনব বলল,”কি রে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি নাকি??সর ভেতরে ঢুকতে দে??”
পূর্ণাশা সাইড দিতেই অভিনব ভেতরে ঢুকলো সাথে রা’দ আর লাবন্য। দুজনে গিয়ে আরাম করে বিছানায় বসলো। আর অভিনব কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ খুলে তাতে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।পূর্ণাশা চুল থেকে তোয়ালে খুলতে খুলতে বলল,”যে হারে বেল বাজাচ্ছিলি আরেকটু হলে তো বেলটা নষ্ট হয়ে যেতো।”
রা’দ বলল,”এটা সম্পূর্ণ অভিনবের কাজ।”
তখনই রান্নাঘর থেকে অভিনব এসে বলল,”ফ্রিজে তো সবজি ছাড়া কিছুই নেই।এই ফকিন্নি কি খাওয়াবি আমাদের?? আমার তো খুব খিদে পেয়েছে।”
পূর্ণাশা হেসে ফেললো এই অভিনবকেই তো চেয়েছিল । পূর্ণাশা বলল,”কিছুই নেই ফ্রিজে আর খাওয়ার কিছুও নেই। পাস্তা আর নুডুলস আছে যা গিয়ে রান্না করে খা।”
অভিনব চোখ কুঁচকে সিংগেল সোফায় বসে বলল,”তোর বাড়িতে এসেছি তুই রান্না করে খাওয়াবি তাড়াতাড়ি যা।”
পূর্ণাশা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। কিচেনে গিয়ে পাস্তা আর নুডুলস সেদ্ধ হতে দিয়ে কাটাকুটি করতে লাগলো। অভিনব পাস্তা খায় না তাই পূর্ণাশা নুডুলস এনে রাখে। পূর্ণাশা পাস্তা খেতে পছন্দ করে নুডুলস বেশি একটা খায় না। রান্না শেষ করে সবাইকে সার্ভ করে নিজে খেতে বসলো। পূর্ণাশা খেতে খেতে বলল,”তো হঠাৎ এলি তোরা?? আমাকে তো ফোন করে জানালি না??”
লাবন্য খেতে খেতে বলল,”অনেক দিন পার হয়ে গিয়েছে। আমাদের তো দ্যা বুক ওপেন করতে হবে। দেখতে হবে না যে এরপর কার গল্প তৈরি হলো।”
সাথে সাথে পূর্ণাশার মুখটা থমথমে হয়ে যায় বলে,”ওহ,আজকেই পড়তে হবে।”
রা’দ বলে উঠলো,”হুম তবে এবার আমরা সবটা জানি বি কেয়ারফুল। আমাদের জিততে হবে।”
সবাই যার যার খাওয়ায় মন দিলো। খাওয়া শেষে সবাই তৈরি হয়ে নিলো। পুরো রুমে মোমবাতি সেট করে জ্বালিয়ে দিলো। প্রথম দিনের মতোই সবটা ঠিক করলো। বই সামনে নিয়ে বসে আছে সবাই। মনে মনে সবাই প্রার্থনা করতেছে যাতে ভয়ংকর কোন বিপদ না আসে ওদের সামনে। রা’দ আলতো করে বইটা খুললো। তারপর পড়তে শুরু করলো।অভিনবের গল্পটা শেষ,প্রথমে বইতে যা লেখা ছিল তার সাথে পরের কাহিনী যোগ হয়েছে। সেন্টমার্টিনে দেখা হওয়া জলপরীকে মারা ইত্যাদী সব। শেষে বড়বড় করে দ্যা ইন্ড লেখা।
রা’দ পরবর্তী গল্প পড়ার জন্য পরের পাতা উল্টায়।
“আয়না, মানুষের কাছে অতি পরিচিত। আয়না না থাকলে মানুষ তার নিজের চেহারা দেখতে পেত না। মানুষ তার রূপের সৌন্দর্য দেখে এই আয়নাতেই। কিন্তু এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা কুৎসিত দেখতে তারা এই আয়নাকে চায় না। নিজেদের এই কুৎসিত চেহারা তো তারা নিজেরাই পছন্দ করে না। তাদের অনেকেই সৃষ্টিকর্তার দিকে আঙুল তোলে। কেন তিনি ওদের এরকম বানিয়েছে কেন?? কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যে কোন এক বিশেষ উদ্দেশ্য তাদের বানিয়েছেন এটা কেউই ভাবতে চায় না। ‘কখনো নিজেকে অন্যের থেকে কুৎসিত বা অসুন্দর মনে করবেন না। কেননা সৃষ্টিকর্তা কোন এক উদ্দেশ্য নিয়ে আপনাকে তৈরি করেছেন। আর তিনি কখনো ভুল করেন না’।
আয়নায় শুধু সুন্দর চেহারার অধিকারীদের দেখ যাবে তা কিন্তু নয়??যারা দেখতে কুৎসিত তাদেরকেও দেখা যাবে।
এমনই এক কুৎসিত চেহারার পুরুষের বসবাস এই আয়নার ভেতরে। যিনি এক আয়না থেকে অন্য আয়নায় চলাচল করতে পছন্দ করে। সেও চায় তার চেহারায় সৌন্দর্য আসুক। কিন্তু সে কিভাবে তার চেহারার সৌন্দর্য ফিরে পাবে?? কুৎসিত চেহারা তো বদলানো যায় না। এই চিন্তা ভাবনা সে কখনোই করতে চায় না। আর যখন এ চিন্তা তার মাথায় আসে তখন সে হয়ে ওঠে এক হিংস্র জানোয়ার। একজন সাধারণ মানুষের থেকে তার শক্তি সামান্যতম বেশি। তবে এই শক্তিতে সে মানুষের কাছে হার মানবে।
কোন এক কাল থেকে তার বদ্ধ ধারনা যে মানুষই পারে তার এই নিকৃষ্ট চেহারার পরিবর্তন ঘটাতে। সে সম্পূর্ণ অন্য জগতের কেউ। তাই সে মানুষের থেকে নিজের বংশবৃদ্ধি করতে চায়। তার দৃঢ় বিশ্বাস যে এর ফলে তার চেহারা সুন্দর হবে। কিন্তু কার উপর তার এই কুৎসিত ধারনার নজর পড়েছে??যার উপর তার এই ধারনাটা চেপেছে সেই বা কে??আর যদি সে এই সন্তান পৃথিবীতে আনতে পারে তাহলে কি হবে??? তার রূপ পরিবর্তনের এই বদ্ধ ধারণা তো সম্পূর্ণ মিথ্যা।যদি সে পরে এটা বুঝতে পারে তাহলে কি করবে??তার যতটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে কাকে মেরে ফেলবে??ছোট বাচ্চাটা কি বাঁচবে??নাকি সেই নিকৃষ্ট পুরুষের সাথে মিলে তার মা’কে ও মেরে ফেলবে??
শুরু হয়ে গেল মৃত্যু মৃত্যু খেলা। একজন মরলে দুজন মরবে। কিন্তু যার বাবা ভয়ানক তার বাচ্চা তো তার থেকে অধিকতর ভয়ানক। তাহলে কি হবে??মেয়েটা কি আদৌ বাঁচবে এই মৃত্যু খেলায়??”
লেখাগুলো শেষ বাকি পেইজ গুলো সাদা। রা’দ পড়া শেষ করে পূর্ণাশা আর লাবন্যর দিকে তাকালো। ওরা কেমন ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। এটা বুঝতে ওদের বেগ পেতে হলো না যে এই গল্পটা পূর্ণাশা আর লাবন্যর মধ্যে কোন একজনের। কিন্তু কার??নাম বা জন্মতারিখ কোনটাই যে লেখা নেই এখানে।
রা’দ শব্দ করে বইটা বন্ধ করে দিলো।
সবাই এখনও স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না?? এই গল্পটা কেমন এলোমেলো লাগছে। কি সব আজব ধরনের কথা। এরকম কুৎসিত চেহারার কেউ আদৌ আছে যে অন্যজগতের?? এখানে আসার কারণটা এখনও অস্পষ্ট। সবাই চুপ থেকে কিছুটা বোঝার চেষ্টা করতেছে।
চলবে,,,,,,,,,
#THE_BOOK
#পর্ব_১১
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
“এটা কার গল্প??কি কুৎসিত ভাবে লেখা গল্পটা। না জানি এই কুৎসিত চেহারার লোকটা কতটাই না খারাপ!! এখন কি হবে??
আমরা এর হাত থেকে বাঁচব কিভাবে??”
পূর্ণাশার কথা শুনে রা’দ চুপ করে আছে। ওর কিছু বলার নেই। লাবন্য তো শকড,স্থির হয়ে বসে আছে। অভিনব বলল,”সে যাই হোক না কেন আমাদের ভয় পেলে চলবে না। আমরা কিছুতেই ওই খারাপ লোক বা ওর বাচ্চা কাউকেই আসতে দেব না।”
লাবন্য বলল,”তার আগে জানতে হবে এই গল্পটা কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে??”
“জানি না তবে শিঘ্রই জানতে পারবো।”
কেউ আর কোন কথা বলল না। পিনপতন নিরবতা সবার মাঝেই। একটার পর আরেকটা ঝামেলা হয়েই আছে।
রেডিও স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে লাবন্য। আজকে তাড়াতাড়ি ফিরবে। সন্ধ্যা নেমে গেছে। রা’দ আর অভিনব এখনো রেডিও স্টেশনে আছে। ওদের শো এখনও শেষ হয়নি তাই। বাস আসতেই লাবন্য বাসে উঠে বসে। জানালার পাশের সব সিটগুলো বুক হয়ে গেছে। লাবন্য হতাশ হয়ে একটা লোকের পাশে গিয়ে বসলো। বেশি বয়স নয় লোকটার সম্ভবত ত্রিশ এর বেশি হবে। লাবন্য চুপচাপ ফোন স্ক্রোল কলতেছে। পুরো বাসে একটা লাইট জ্বলছে বাকিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। লাবন্য হঠাৎ খেয়াল করলো পাশে বসা লোকটি তার মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করছে। কিন্তু বিড়বিড় করে কি বলছে তা বোঝা যাচ্ছে না। লাবন্য একটু ভয় পেলো তবুও নিজেকে সামলে নিলো কারণ বাসে এখনও আরও মানুষ রয়েছে।
একটু পর লাবন্য দেখলো লোকটা পকেট থেকে ছোট একটা ছুরি বের করেছে। এটা দেখে লাবন্যর গলা শুকিয়ে এসেছে। লোকটা ছিনতাইকারী নয়তো?? কিন্তু লাবন্যর ভাবনায় পানি ঢেলে লোকটা তার হাতের তালু বরাবর ছুরিটা ঢুকিয়ে দিলো। লাবন্য ভয়ে আঁতকে উঠে,ভয়ার্ত চোখে লোকটার দিকে তাকালো। অদ্ভুত দেখতে লোকটা মুখের পাশে একটা কাটা দাগ। লোকটা হাত থেকে ছুরিটা টান দিয়ে বের করে ফেলে সাথে সাথে রক্ত বের হতে লাগলো। রক্ত দেখে লাবন্য আরো ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু লোকটার কোন ভাবান্তর নেই। হাত থেকে ছুরিটা বের করে আবারো একই জায়গায় আঘাত করলো। মুখ দিয়ে একটু শব্দও করলো না।
লাবন্য এবার বেশ ভয় পাচ্ছে। কেউ এভাবে নিজেকে আঘাত করতে পারে??লাবন্য ভয়ে ভয়ে লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল,”এ,,কি আ আপনি এভাবে নিজেকে আঘাত করছেন কেন?? আপনার কি ব্যথা লাগছে না??”
লোকটা এবার লাবন্যর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো যা দেখে লাবন্যর গায়ে কম্পন ধরে গেল। লোকটার চাহনি খুবই তীক্ষ্ণ, চোখের ভেতর হলুদ আভা ছড়িয়ে পড়ছে।লোকটা বলল,”নাহ আমার এরকম করতে খুবই ভালো লাগছে। আপনি করবেন এরকম??দিন আপনার হাত দিন”
লোকটা লাবন্যর দিকে হাত এগিয়ে দিতেই লাবন্য শক্ত হাতে নিজের ব্যাগটা চেপে ধরে বলল,”ন না না আমি এরকম করব না।”
লোকটা আর লাবন্যকে কিছু বলল না আবার ছুরিটা নিজের হাতে ঢুকিয়ে দিলো। রক্তে প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে লোকটার তবুও থামছে না। আবারও বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।লাবন্য তো ভয়ে পুরোপুরি নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে। কান পেতে বুঝতে চাইলো যে লোকটা কি বলছে?? কিন্তু লোকটার কোন কথাই লাবন্য বুঝতে পারছে না। শুধু একটা কথাই বোঝা যাচ্ছে,”কেউ আমাকে পছন্দ করে না। সব শেষ করে দেব।”
এই কথাগুলো বারবার বলছে। লাবন্যর এবার বুঝতে কিছুই বাকি রইল না যে এই সেই ব্যক্তি যার কথা দ্যা বুক এ লেখা ছিলো। আর দ্বিতীয় গল্প লাবন্য কে নিয়েই লেখা হয়েছে।লাবন্য কম্পিত হাতে রা’দকে ফোন করলো।
সবে শো শেষ করে বের হয়েছে রা’দ আর অভিনব। লাবন্যর ফোন পেয়ে দ্রুত রিসিভ করে বলল,”হ্যা বল।”
লাবন্য থেমে থেমে বলল,”রা’দ দ্যা বুক এর পরবর্তী শিকার আমি।”
রা’দ অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে গেছে বলে,”কি বলছিস তুই??তুই এখন কোথায়??”
“বাসের ভেতর আর ওই কুৎসিত লোকটা আমার পাশের সিটে বসা।”
“কি??”
লাবন্য কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল,”রা’দ আমার খুব ভয় করছে আমি এখন কি করবো??”
“তুই বাস থেকে নেমে পড় আমরা আসছি।”
“ওকে তাড়াতাড়ি আয় আমার খুব ভয় করছে।”
লাবন্য ফোন রেখে আশেপাশে তাকালো। কিন্তু অবাক করা বিষয় যে বাসে ও আর ওই লোকটা ছাড়া আর কোন যাত্রী নেই। একটু আগেও তো কতো যাত্রী ছিলো। আর বাস তো কোথাও থামেনি তাহলে সবাই গেলো কোথায়?? তাহলে সবটা কি চোখের ধাঁধা ছিলো??লাবন্যর ভয়টা আরো গাঢ় হচ্ছে।লাবন্য গলা উঁচিয়ে কন্ডাক্টরকে ডেকে বলল গাড়ি থামাতে কিন্তু কারো কোন সাড়া নেই বিধায় লাবন্য আবারও ডাকালো। এবারো কোন সাড়া নেই। লাবন্য উঠতে নিলেই লোকটা খপ করে লাবন্যর হাত চেপে ধরলো।লাবন্য ভয়ে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে বলল,”ছাড়ুন আমায় বাঁচাও,কেউ আছো??”
লোকটা এবার তার বিশ্রি দাঁতগুলো বের করে হাসতে লাগলো। হলদে দাঁতগুলো জঘন্য দেখতে। যে কারো বমি এসে যাবে। এতে লাবন্য এতটাই ভয় পেলো যে জ্ঞান হারানোর উপক্রম। কিন্তু লাবন্য নিজেকে শক্ত করলো কারন এখন জ্ঞান হারালে চলবে না ওকে লড়তে হবে। লাবন্য লোকটার হাত থেকে ছোটার জন্য ছটফট করছে আর বলছে,”ছেড়ে দাও আমাকে নাহলে কিন্তু,,,”
লোকটা আবারো হাসতে লাগলো। কি বিশ্রী সেই হাসি। লাবন্য বলল,”আমি বাড়ি যাব ছাড়ো আমাকে।”
“এই বাস তো তোমার বাড়ি যাবে না।”
“কোথায় যাবে তাহলে??”
লোকটি আবারো বিশ্রি হেসে বলল,”শশ্মানে যাবে।”
“কি???”
লাবন্য এবার কেঁদে দিয়েছে। ভাবছে এবার বুঝি সব শেষ হয়ে যাবে। ওর আর বাঁচা হবে না। কিন্তু শেষ চেষ্টা করার জন্য লাবন্য লোকটাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে দৌড় দিলো কিন্তু তাতে লাভ হলো না। এক কদম যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মেঝেতে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো লোকটা আবারো ওর দিকেই আসছে। লোকটা কাছে আসতেই তার চেহারার পরিবর্তন হতে লাগলো। আগের থেকে আরো কুৎসিত আর ভয়ঙ্কর চেহারায় পরিণত হলো তার মুখ। যা লাবন্যর চোখে সইছে না। এমন বিদঘুটে চেহারা লাবন্য ওর লাইফে কোনদিন দেখেনি। লাবন্য ভয়ে জোরে জোরে চেঁচাতে লাগলো। কিন্তু ওর চিৎকার আশেপাশের কেউই শুনতে পেলো না। লাবন্য চিৎকার করে বলতে লাগলো,”সরে যাও আমার সামনে থেকে। তোমার মুখটা আমার সহ্য হচ্ছে না। সরে যাও আমি আর নিতে পারছি না।”
লাবন্যর কথায় কুৎসিত মানবি ভিশন খেপে গিয়ে বললো,”আমাকে আমার সুন্দর রূপ ফিরিয়ে দে। তুই পারবি, আমার বাচ্চা আমার রূপের পরিবর্তন আনবে। এখন আমাকে কেউ দেখতে পারে না। আমার বাচ্চা আসলে তার শক্তিতে আমি আমার চেহারা বদলাতে পারবো। তুই পারবি তুই পারবি।”
লাবন্য হামাগুড়ি দিয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলল,”আমি পারবো না তোমার মতো এক কুৎসিত মানুষকে আম সাহায্য করব না। তোমার মুখটা যেমন কুৎসিত তোমার মনটাও তেমন কুৎসিত। তুমি দূরে সরে যাও। তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”
লাবন্য চিৎকার করে কথাগুলো বলল।
“তোর অনুমতি আমার চাই না। আমি শুধু আমার ইচ্ছা পূরণ করতে চাই।”
“এটাই দ্য বুক এ লেখা ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করো এতে তোমার মুখের পরিবর্তন হবে না। তোমার ভাবনা সম্পূর্ণ মিথ্যা। শুধু শুধু আমার ক্ষতি করো না।”
কুৎসিত মানবি লাবন্যর কথায় আরো রেগে গেলো। ছো মেরে লাবন্যর ওড়নাটা নিয়ে ফেলে দিলো পাশের সিটে। লাবন্যর বুক ধড়ফড় করছে কি করবে বুঝতে পারছে না।এই কুৎসিত মানবির কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া মানেই মৃত্যু। লোকটা লাবন্যর কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসতেই লাবন্য তাকে ধাক্কা দিলো। কিন্তু লোকটাকে নড়াতে পারলো না।লাবন্যর সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিলো।লাবন্য হাল ছাড়ছে না ওর মাথায় শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে হাল ছাড়া যাবে না।
লাবন্যর জামাটা কাঁধের অংশ খানিকটা ছিঁড়ে গেছে তবুও লাবন্য হাল ছাড়ছে না। শেষে উপায় না পেয়ে লাবন্য লোকটার মুখের উপর এক ঘুসি মেরে দিলো। নাকে হাত দিয়ে লোকটা পিছিয়ে গেলো। লাবন্যর হাতে পাথরের আংটি ছিলো যার কারণে লোকটার নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। লাবন্য ভাবতে লাগলো যে লোকটা ওকে আক্রমণ করার আগেই ওকে কিছু একটা করতে হবে। হঠাৎ ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। লাবন্য জোরে চেঁচিয়ে বলল,”নিজের মুখটা কখনো আয়নায় দেখেছো?? তোমার চেহারা কতটা কুৎসিত তা দেখেছো কখনো??”
লোকটা লাবন্যর কথায় থম মেরে গেলো।এই একটাই জিনিসে ওর দূর্বলতা। আয়নার কথা আসতেই লোকটা চারিদিকে আয়না খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও আয়না নেই। আয়না খুঁজে না পাওয়ায় লোকটা ছটফট করছে। চারিদিকে শুধু আয়না খুজতেছে। লাবন্য এবার কিছু কিছু আন্দাজ করতে পারছে।লাবন্য লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,”আয়না খুজছো তো। কিন্তু বাসে তো আয়না নেই। আয়না খোঁজার জন্য তোমাকে বাস থামাতে হবে।”
বলার সাথে সাথে জোর বেগে বাস থেমে গেলো। লাবন্য তাড়াতাড়ি নিজের ব্যাগ আর ওড়না আঁকড়ে ধরলো। লোকটা তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে পড়লো। আয়না খোঁজার জন্য দূরে যেতে হলো না বাসের লুকিং গ্লাস পেয়ে তার দিকে তাকিয়ে নিজের চেহারা দেখতেছে। মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে অদ্ভুত শব্দ বের করছে বলছে,”এই চেহারা বদলে ফেলব সে আসবে। সে এসে আমার চেহারা বদলে দেবে।”
আয়না দেখে এবার শান্ত হচ্ছে লোকটা। পিছনে ঘোরার আগেই তাকে জোরে ধাক্কা দিলো লাবন্য। সাথে সাথেই লোকটা আয়নার ভেতর ঢুকে গেল। লাবন্য আর এক মূহুর্ত দেরি না করে নিজের ওড়না খুলে লুকিং গ্লাসে জড়িয়ে দিলো যাতে লোকটা বের হতে না পারে।
লাবন্য প্রাণপনে ছুটছে বাসটা এক নির্জন রাস্তায় থেমেছিলো। সেখান থেকে লোকালয়ে আসার জন্য লাবন্য ছুটছে। চারিদিকে শুধু অন্ধকার।এই অন্ধকারে প্রাণপণে ছুটছে লাবন্য। তখন ওর রা’দের কথ মনে পড়লো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রা’দকে ফোন করলো। লাবন্যর ফোন পেয়ে দ্রুত রিসিভ করেই বলল,”লাবন্য তুই কোথায়??কত জায়গায় খুঁজছি তোকে।”
লাবন্য হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,”জানি না আমি কোথায় রা’দ এখানে কেউ নেই। ফাঁকা রাস্তা আমাকে বাঁচা রা’দ প্লিজ।”
“তুই কাদিস না, লোকালয়ে আসার চেষ্টা কর।ফোন অন রাখিস আমি ম্যাপ দেখে লোকেশন ট্র্যাক করে আসছি।”
রা’দ ফোন কেটে অভিনবকে বলল লোকেশন ট্র্যাক করতে। তারপর রা’দ বাইকে চেপে বসে।
হন্তদন্ত হয়ে বাইক চালাতে লাগল।ওর উদ্দেশ্য একটাই যে লাবন্যকে বাঁচাতে হবে।
লাবন্য ছুটতে ছুটতে দেখতে পেল সামনে একটা দোকান তাতে কয়েকজন লোক ও আছে। লাবন্য দৌড়ে সেখানে গেলো। ওখানের লোকগুলো বয়স্ক। তারা লাবন্যকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে কেমন চোখে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু লাবন্য ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। জামার ছেঁড়া অংশে ব্যাগ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।ভয়ে ঠকঠক করে কাপতেছে। হঠাৎ ফোন আসাতে লাবন্য রিসিভ করতেই রা’দ বলল,”লাবন্য আমরা তো কাছাকাছি চলে এসেছি তুই কোথায় বলতে পারবি??”
লাবন্য পাশে থাকা লোকগুলোর থেকে লাবন্য জায়গার জেনে রা’দকে বলল। মিনিট বিশেক পর রা’দ আর অভিনব সেখানে চলে এলো। ওদের দেখে লাবন্য দৌড়ে গেল। লাবন্য রা’দকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। অভিনব লাবন্যর এই অবস্থা দেখে নিজের জ্যাকেট খুলে লাবন্যর গায়ে জড়িয়ে দিলো।
লাবন্য শক্ত করে রা’দ কে ধরে কাদতেছে সাথে ভয়ে কাপতেছে ও। অভিনব অসহায় চোখে লাবন্যর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর উচিৎ ছিলো লাবন্যকে বাড়িতে পৌছে দেওয়া। না হলে আজকে লাবন্যর এই বিপদটা হতো না। নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে অভিনবের। কি করে বন্ধুর খেয়াল রাখলো না।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,