THE_BOOK #পর্ব_৮,০৯

0
265

#THE_BOOK
#পর্ব_৮,০৯
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
০৮

শহরের বুকে বিকেল নেমে এসেছে। সূর্যের প্রখরতা কমে গিয়েছে। শান্ত হাওয়া বইছে চারদিকে মানুষ জন যে যার কাজে ব্যস্ত।কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। তাকানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই কারো কাছে।এই পৃথিবীটা এরকমই সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। স্বার্থ ছাড়া কেউ কারো সাথে চলতেই চায় না। রা’দ মাত্র বের হলো। সকাল থেকে এই পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। সকালেই ইংল্যান্ড থেকে ফিরে বড় একটা ঘুম দিয়েছে। লাবন্য আর পূর্ণাশার সাথে কথাও হয়নি ওর। তাই এখন উদ্দেশ্য লাবন্য আর পূর্ণাশার সাথে দেখা করা। বাইকে বসে পকেট থেকে চাবি বের করতেই কেউ একজন ওর হাত ধরলো। রা’দ চকিতে হাতের মালিকের দিকে তাকালো। চুড়িভর্তি হাতজোড়া অসম্ভব সুন্দর। মেয়েটার কাজলে আঁকা চোখদুটো থেকে মায়া ঝরে পরছে। পরনে তার নেভি ব্লু রঙের থ্রিপিস। ফর্সা মানুষকে এই রঙটা বেশ মানায়। রা’দ এসময় জাবিনকে দেখে অবাক হলো তারপর বলল,”তুমি!!”

জাবিন রা’দের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,”হ্যা আমি।”

“কেন এসেছো??”

“আসতে পারিনা বুঝি??”

“যদি তুমি আমার মা আর বোনের কাছে আসো তাহলে সমস্যা নেই। তবে এইভাবে পরপুরুষের সামনে এসে তার হাত ধরা ঠিক নয়। সমাজ তা খারাপ চোখে দেখে।”

“জানি, আপনার হাত ধরার অধিকার আমার নেই। কিন্তু সেই অধিকার টা তো চাইছি কেন দিচ্ছেন না??কেন আমার ভালোবাসাকে হেলা করছেন??”

“অন্য কাউকে বিয়ে করে নাও তাহলে তার প্রতিও তোমার ভালোবাসা চলে আসবে তখন সুখি হবে।”

রা’দের এমন কথা শোনার জন্য জাবিন মোটেও প্রস্তুত ছিল না। রা’দ এতটা নিষ্ঠুর কেন?? কেন ওর ভালোবাসা বুঝতে পারছে না। জাবিন ধরা গলায় বলল,”সেটা বোধহয় কখনো হবে না। ভালোবাসার মানুষ ব্যতিত অন্য কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। আমি আপনাকে ভালোবাসি আর সারাজীবন বাসবো।”

“যদি এটা জানতে পারো যে মৃত্যু আমার খুবই কাছে। যদি আমি মারা যাই তখন?? তখন ও কি একইরকম ভালোবাসবে??”

রা’দের কথা শুনে জাবিন স্তব্দ হয়ে গেল। হঠাৎ রা’দ এরকম কথা বললো কেনো??জাবিন কৌতুহলী হয়ে বলল,”এরকম কথা বলছেন কেন??কি হয়েছে আপনার?? কোন খারাপ রোগ??”

“না তবে মৃত্যু আমার সন্নিকটে। তাই বলছি তুমি অন্যকাউকে বিয়ে করে নাও তুমি সুখি হবে। আর এসব ব্যাপারে মা’কে কিছু বলো না।”

জাবিন স্মিত হেসে বলল,”ভালোবাসা সহজ হলেও ভোলা সহজ নয়। মানুষ পৃথিবীতে চিরস্থায়ী নয়। মানুষের মৃত্যু হলেও মনের মৃত্যু কি হয়?? মানুষের আত্মার মৃত্যু হয় না কখনো। মানুষ মরে গেলেও মনে ঠিকই থেকে যায়। সেই মানুষটার অস্তিত্ব মনের মধ্যে অনুভব করা যায়। আমি জানি না আপনার কি হয়েছে তবে আপনার জন্য আমি অপেক্ষা করবো।”

রা’দ জাবিনের সাথে কতা না বাড়িয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। জাবিন ফ্যালফ্যাল চোখে রা’দের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পর চোখে ঝাপসা দেখলো।জাবিন বুঝতে পারলো যে ওর চোখ পানিতে ভরে গিয়েছে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরার আগেই তা মুছে ফেলল জাবিন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসে পৌঁছাল রা’দ।পূর্ণাশা আর লাবন্য এসে পড়েছে। রা’দকে দেখে ওরা দুজনেই চমকালো। পূর্ণাশা রা’দকে বলল,”তুই চলে এসেছিস আমাদের তো বললি না।”

রা’দ চেয়ার টেনে বসে বলল,”টায়ার্ড ছিলাম তাই কল করতে ভুলে গেছি।”

পূর্ণাশা আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই রা’দ ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল,”সব কিছু বলব তবে পরে।”

ওরা দুজনেই চুপ করে গেল। তবে রা’দের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো যে রা’দ ভালো কোন খবর দিতে পারবে না।
আজকে কোন লাইভ শো করবে না রা’দ অভিনব নেই তাই রা’দের মনটাও খারাপ। এই চাকরিটাও ছেড়ে দিবে। পূর্ণাশা অলরেডি দুইটা ইন্টারভিউ দিয়ে ফেলেছে এখন রেজাল্ট বেরোনো বাকি।

রাত নয়টা বাজে। পূর্ণাশার ফ্ল্যাটে সবাই উপস্থিত হয়েছে। লাবন্য খাটের উপর হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে পূর্ণাশা দরজায় হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে আর রা’দ সোফায়।
কারো মুখে কোন কথা নেই। পিনপতন নীরবতা সবার মাঝে। একটু আগে রা’দ সম্পূর্ণ ঘটনা এদের বলেছে। ফাদারের বলা প্রতিটা কথা বলেছে যা শুনে লাবন্য আর পূর্ণাশা স্তব্ধ হয়ে গেছে।
নিরবতা ভেঙ্গে পূর্ণাশা বলল,”তারমানে শুধু অভিনব নয় মৃত্যু আমাদের ও তাড়া করছে!!”

লাবন্য কোমল কন্ঠে বলল,”আমাদের এখন কি করা উচিৎ?? মৃত্যুকে মেনে নেওয়া নাকি বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করা??”

রা’দ বলল,”লড়াই তো আমাদের করতেই হবে। অভিনবকে বাঁচাতে হবে এবং নিজেদেরকেও বাঁচতে হবে। ওই বইয়ের অভিশাপ থেকে আমরা বাঁচার চেষ্টা করব। যদি বেঁচে যাই তাহলে ওই বইটার অভিশাপ ও দূর হয়ে যাবে।”

“কিন্তু আমরা কি করে পারবো??যেখানে বব হেনরি কিছু করতে পারলো না।”

“বব হেনরি ওই আত্মাদের বের করার চেষ্টা করছিলো। ওই বইটা হঠাৎ ওনার মা পড়ে তখন বব দেশের বাইরে ছিলো একটা কাজে। যখন ওনার মা মারা যায় তখন থেকেই উনি এই বইটা থেকে সব আত্মাদের বের করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ততদিনে বইটাতে সব আত্মাদের অভিশাপ লেগে গিয়েছিল। যার কারণে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তাই বব হেনরি তার মৃত্যুর আগে বইটা তার কবরে রাখতে বলেছিল যেন কেউ পড়তে না পারে আর কারো যেন মৃত্যু না হয়। কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করেনি।”

লাবন্য হতাশ হয়ে বলল,”তাহলে তো আমাদের ও মৃত্যু হবে।”

“জানি না তবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবেই। আমরা চারজন মিলে সর্বচেষ্টা করব বেঁচে থাকার।”

পূর্ণাশা বলল,”কিন্তু ওই শক্তিশালী জলপরীর সাথে লড়াই করা তো অসম্ভব।”

“অসম্ভব কে সম্ভব করতে হবে। পৃথিবীর সর্বশক্তিশালি মানুষের ও দূর্বলতা আছে। তেমনি ওই জলপরীর ও দূর্বলতা আছে। আমাদের সেই দূর্বল জায়গায় আঘাত হানতে হবে।”

“কিন্তু কি সেই দূর্বলতা???”

রা’দ কোন কথা বলল না চুপ করে বসে রইল।
আজকে লাবন্য আর পূর্ণাশা কাঁদছে না। কেঁদে আর কি হবে যা হওয়ার তা অলরেডি হয়ে গেছে।

পরেরদিন,
দশটা নাগাদ হসপিটালে পৌঁছায় রা’দ পূর্ণাশা আর লাবন্য। মূলত অভিনবের সাথে দেখা করা। ধীর পায়ে ওরা কেবিনে প্রবেশ করলো। অভিনবের মুখের দিকে তাকাতেই রা’দের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। কি চেহারা হয়েছে অভিনবের??যে ছেলেকে দেখলে মেয়েরা ক্রাশ খেতে বাধ্য। যে ছেলের এটিটিউড দেখলে শত শত মেয়েরা তার প্রেমে পড়ে যায়। সেই ছেলের হাল কি হয়েছে?? চোখদুটো লেগে রয়েছে মুখটা পানসে হয়ে গেছে। শুকিয়ে পুরো কংকালের মতো হয়ে গেছে। রা’দ অনেক কষ্টে কান্না আটকালো।অভিনবের কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। পরক্ষণেই অভিনব চোখ মেলে তাকালো। রা’দকে দেখেই অভিনব ওঠার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। শরীরটা ওর ভিশন দূর্বল রা’দ অভিনবকে ধরে বসালো। অভিনব ধীর গলায় বলল,”রা’দ তুই এসেছিস!! আমাকে বাঁচা,আমি বাঁচতে চাই। এখানে থাকলে আমি মরে যাবো।”

রা’দের এবার ভিশন কষ্ট হচ্ছে। পূর্ণাশা আর লাবন্য কেঁদেও ফেলেছে। রা’দ বলল,”তুই ওই মেয়েটার কাছে যেতে চাস তাইতো??”

অভিনব মাথা নাড়িয়ে বলল,”হ্যা।”

“ভারোবাসিস ওই মেয়েটাকে??”

“খুব ভালোবাসি আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারব না।”

রা’দ মুখে হাসির রেখা টেনে বলল,”ওকে ফাইন আমি তোকে নিয়ে যাব ওই মেয়েটার কাছে যাবি??”

রা’দের কথা শুনে অভিনব খুশি হয়ে বলল, “সত্যি তুই আমাকে নিয়ে যাবি??”

“হ্যা যাব।”
লাবন্য বলে উঠলো,”রা’দ কি বলছিস তুই এসব??”
রা’দ চোখের ইশারায় ওদের দুজনকে থামতে বলল। তারপর অভিনবকে বলল,”শুধু আমি কেন পূর্ণাশা আর লাবন্য ও যাবে। তুই আমাদের বন্ধু তোর কথা আমরা না রেখে পারি?? তবে তুই কি ওই মেয়েটাকে একবারও বলেছিস যে তুই ওকে ভালোবাসিস??”

“ন না আমি বলিনি। সময় পেলাম কোথায়??”

“আচ্ছা তাহলে তুই এবার ডিরেক্ট প্রপোজ করবি। পারবি তো??”

অভিনব খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,”পারবো।”

“ওকে, আমি পূর্ণাশা আর লাবন্য লুকিয়ে লুকিয়ে ভিডিও করব। তুই কিন্তু বলবি না কাউকে??”

“আচ্ছা বলব না তুই তাড়াতাড়ি নিয়ে চল আমাকে।”

“তুই বস আমি ডক্টরের সাথে কথা বলে আসছি।”

রা’দ কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো। লাবন্য পূর্ণাশা ও বেরিয়ে এলো। পূর্ণাশা বলল,”এসব তুই কি করতে চাইছিস রা’দ??”

“অভিনবকে বাঁচাতে চাইছি।”

পূর্ণাশা অবাক হয়ে বলল,”ওই জলপরীর কাছে নিয়ে গেলে তো অভিনবকে মেরে ফেলবে।”

“আর অভিনবকে ছাড়া আমরা জলপরীকে ধরতে পারব না। তাই জলপরীকে ধরার একমাত্র টোপ হলো অভিনব।”

লাবন্য এগিয়ে এসে বলল,”এক মিনিট তুই জলপরীকে ধরতে চাইছিস মানে??তুই কি জলপরীকে মারার প্ল্যান করছিস??”

“একজ্যাটলি তাই।”

“কিন্তু কিভাবে মারবি??তোর কি মনে হয় তুই পারবি??”

“তোরা আছিস না আমার সাথে।”

পূর্ণাশা আর লাবন্য দু’জনেই অবাক হয়ে রা’দের দিকে তাকিয়ে রইল। রা’দ আবার বলল,”দেখ জলপরী আমাদের কাউকে আঘাত করতে পারবে না। তাই আমাদের শক্তি ওই জলপরীর থেকে কম ও না। জলপরী বেঁচে থাকলে অভিনব মারা যাবে আর অভিনবকে বাঁচাতে হলে জলপরীকে মারতে হবে। নয়তো অভিনবের সাথে সাথে আমাদের ও মরতে হবে। কথা ক্লিয়ার??”

পূর্ণাশা মাথা নাড়িয়ে বলল,”আমি পুরোপুরি বুঝতে পারলাম না।”
লাবন্য ও পূর্ণাশার কথায় সায় দিলো। রা’দ বিরক্ত হয়ে বলল,”তোদের বেশি কিছু বুঝতে হবে না শুধু এটা মাথায় রাখ যে জলপরীকে আমাদের ধরতে হবে। আর তা আজকেই। তোদের আমি যা বলব শুধু তাই করবি।”

লাবন্য আর পূর্ণাশা মাথা নাড়ল কিন্তু রা’দের কথার আগা গোড়া কিছুই বুঝলো না। রা’দ কথা না বাড়িয়ে ডক্টরের কেবিনে গেল।ডক্টরকে বলে অভিনবকে নিয়ে এলো।পূর্ণাশা আর লাবন্য শুধু রা’দের কান্ড দেখতেছে।কি করতে চাইছে রা’দ???

একটা পিকআপ ভ্যান ভাড়া করে এনেছে রা’দ। ও নিজেই ড্রাইভ করবে। পূর্ণাশা আর লাবন্যকে পিকআপের ভেতরে রেখেছে আর অভিনবকে ওর সাথে বসিয়েছে। অভিনব তো
বেজায় খুশি আজকে ওর প্রেয়সিকে প্রপোজ করবে। তাই আগের মতো হিংস্র ভাবটা নেই।
রা’দ শহর থেকে দূরে একটা নদীর তীরে গাড়ি থামায়। এখানে মানুষ খুবই কম আসে। আর এই ভরদুপুর বেলায় তো আসেই না। তাই রা’দ এই জায়গাটাই বেছে নিয়েছে।
নদীর তীরে কাশবনে ভরে গিয়েছে। এই বনে কেউ লুকিয়ে থাকলে তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। রা’দ গাড়ি থেকে নেমে পূর্ণাশা আর লাবন্যকে বের করলো। পিকআপের ভেতর থেকে বড় একটা ব্যাগ বের করে লাবন্যর হাতে দিলো। রা’দ অভিনবের হাতে এক তোড়া ফুল গুঁজে দিলো আর বলল লুকিয়ে রাখতে।যখন জলপরী ওর সামনে আসবে তখন যেন বের করে। অভিনব পেছনে প্যান্টের সাথে ফুলের তোড়াটা গুজে রাখলো। তারপর ওরা কাশবন পেরিয়ে নদীর তীরে যেতে লাগলো।
লাবন্য আর পূর্ণাশা এগোতে পারছে না। কাশবনের ধারালো পাতায় হাত পা ছিড়ে যাচ্ছে।
নদীর তীরে অভিনবকে একা পাঠালো তারপর ওরা তিনজন কাশবনের ভেতর লুকিয়ে লুকিয়ে জলপরীর অপেক্ষা করতে লাগলো।রা’দ ভেবেই নিয়েছে আজ হয় ওরা মরবে না হয় ওই জলপরীকে মারবে।

চলবে,,,,,,,,,

#THE_BOOK

#পর্ব_৯

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

দুপুরবেলা সূর্য খাড়াভাবে কিরণ দিচ্ছে। সূর্যের এই তেজ আরো বেড়ে চলেছে। কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে রা’দের। পূর্ণাশা
আর লাবন্যর অবস্থা ও কাহিল। ওরা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। আধঘন্টা যাবত ওরা দাঁড়িয়ে আছে জলপরী তো দূরের কথা একটা মাছের দেখাও নেই। ওদিকে অভিনব শান্তিতে দাঁড়িয়ে আছে,এতো অসুস্থ তবুও ওর মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই।

হঠাৎ ওরা দেখলো নদীর পানি আস্তে আস্তে ঘোলাটে হয়ে আসছে। রা’দ একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো তারপর ব্যাগটা খুলতে লাগলো।পূর্ণাশা আর লাবন্য নিরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে রইল। পানি ভেদ করে জলপরী উঠে এলো অভিনবের সামনে। ঠোঁটের কোণে তার সেই মন ভুলানো হাসি যা অভিনবের বরাবরই পছন্দ। অভিনব মুগ্ধ চোখে জলপরীর দিকে তাকিয়ে রইল। সোনালী রঙের চুলগুলো চিকচিক করতেছে যার কারণে জলপরীর সৌন্দর্য আরও বেড়ে যাচ্ছে। অভিনব এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। হাঁটু পানি পর্যন্ত এগিয়ে এসে ও থামলো। লাবন্য পূর্ণাশা মুখে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। অভিনবের জন্য ওদের খুব কষ্ট হচ্ছে। জলপরী হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”এতদিনে তোমার আসার সময় হলো??আমি তো সেই কবে থেকে তোমার অপেক্ষায় আছি।”

অভিনব হেসে বলল,”অপেক্ষা করানোর জন্য ক্ষমা চাইছি। আজকে আমি তোমাকে প্রেম নিবেদন করতে এসেছি দয়া করে আমার প্রেম গ্রহণ করো।”
অভিনবের কথায় জলপরী হাসলো। অভিনব প্যান্টের পিছন থেকে ফুলের তোড়া এনে জলপরীর দিকে এগিয়ে দিলো। ফুলগুলোর দিকে তাকাতেই জলপরীর চোখগুলো লাল বর্ণ ধারণ করলো। খিচে চোখ বন্ধ করে অভিনবের থেকে দূরে সরে গেল। চোখ বন্ধ অবস্থায় বলতে লাগলো,”দূরে সরে যাও আমার কাছে এসো না দূরে যাও।”

কিন্তু অভিনব আরো এগিয়ে এসে জলপরীর হাত ধরতেই অভিনবকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। এতো জোরে ধাক্কা দিয়েছে যে অভিনব ছিটকে নদীর তীরে এসে পড়লো এবং সাথে সাথে জ্ঞান হারালো। জলপরী ভয়ানক গর্জন শুরু করে দিয়েছে। পানিতে ডুব দেওয়ার আগেই বিরাট এক জাল এসে পড়লো জলপরীর উপর। এই জাল থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না জলপরী। বেরোনোর যতো চেষ্টা করছে ততই জালে আরো বেশি জড়িয়ে পরছে। একে তো চোখজোড়া ভিশন জ্বালাপোড়া করতেছে তার উপর আবার জালে জড়িয়ে গেছে। এ তো এক ভয়ংকর অবস্থা।
রা’দ ঠিক সময়ে জাল ফেলেছে যার কারণে জলপরী ধরা পরেছে। পূর্ণাশা আর লাবন্য ও থেমে নেই দড়ি দিয়ে জলপরীকে ভালোভাবে বেঁধে ফেলেছে। জালের উপর দিয়েই জলপরীর মুখটাও বেঁধে দিয়েছে যাতে চেঁচাতে না পারে।
তিনজন মিলে জলপরীকে বেঁধে পিকআপের ভেতরে ঢুকালো। তারপর অভিনবকে ও নিলো। এখন ওদের গন্তব্য হলো গাজিপুর।লাবন্য আর পূর্ণাশা এখনও বুঝতে পারছে না রা’দ কি করতে চাইছে??ঢাকা থেকে বেশি দূরে নয় গাজিপুর তাই তাড়াতাড়ি ওরা পৌঁছে গেলো।

গাজিপুরের জয়দেবপুর একটা কৃষি ইনইস্টিটিউটে রয়েছে বিশাল সূর্যমুখি ফুলের বাগান। প্রতিদিন অনেকেই আসে এই হলুদের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। কিন্তু এখন দূপুরের রোদ থাকার কারণে কেউ নেই। তাছাড়া এই বাগনটা দুদিনের জন্য মোটা অংকের টাকা দিয়ে ভাড়া করেছে রা’দ।পর্যটক কেনো এখানে কোন কর্মিও আসতে পারবে না। গাড়ি নিয়ে রা’দ ভেতরে ঢুকলো।
বাগানের ভেতরে একটা খালি জায়গা আছে।যেখানে দাঁড়ালে শুধু সূর্যমুখি ফুল দেখা যায় চারিদিক থেকে।
খালি জায়গাটাতে বিশাল বড় চারকোনা কাঁচের তৈরি একুরিয়াম রাখা। রা’দ গিয়ে পিকআপের দরজা খুলে দিলো। অভিনব এখনো অজ্ঞান। তিনজন মিলে জলপরীকে ধরে ওই‌ একুরিয়ামের মধ্যে ফেলে দিলো। চারিদিকে তাকিয়ে জলপরী শুধু ছটফট করছে। ছোটাছুটি করতেছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। মাছের মতো লম্বা লেজটা দিয়ে একুরিয়ামের কাঁচের দেওয়ালে আঘাত করতেছে কিন্তু ভাঙতে পারছে না। গায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে শক্তি নেই। সব শক্তি আস্তে আস্তে ফুরিয়ে যাচ্ছে।
এতোক্ষণে রা’দের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।লাবন্য এবার রা’দের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,”রা’দ এবার তো সবটা বলবি নাকি??আর এই জলপরী হঠাৎ এরকম হয়ে গেল কেন??”

রা’দ পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে বলল,”জলপরীর একটা দূর্বলতা হলো সূর্যমুখি ফুল। সেদিন ফাদারের থেকে জানতে পারি যে জলপরীরা সূর্যের আলোতে সূর্যমুখি ফুল একদম সহ্য করতে পারে না।যার কারণে ওরা কিছুক্ষণের জন্য চোখের ক্ষমতা হারায়। সেই সুযোগটাই আমি নিয়েছি। প্রথমত অভিনবের হাতে সূর্যমুখি ফুল দিয়ে প্রপোজ করতে বলেছি যাতে জলপরীর দূর্বল জায়গায় আঘাত হানতে পারি। আর সেটাই হয়েছে আমার প্ল্যান সাকসেসফুল।”

এতোক্ষণে পূর্ণাশা আর লাবন্য সবটা বুঝতে পারলো। দু’জনের মুখেই এখন খুশি। পূর্ণাশা বলল,”তারমানে অভিনব বেঁচে যাবে।আমরা অভিনবকে হারাবো না।”
লাবন্য বলল,”কিন্তু এই জলপরীর কি হবে এখন??”
রা’দ জলপরীর দিকে তাকিয়ে বলল,”জলপরী এই অবস্থায় ডাঙায় বেঁচে থাকতে পারবে না। কারণ সন্ধ্যা নামতে এখনো দেরি। চারঘন্টার বেশি সময় লাগবে। আর তাছাড়া কাল অবধি ও জলপরী এখানেই থাকবে। এই দুদিনেই জলপরীর তার সব শক্তি হারাবে। তারপর ওকে মারতে আমাদের কষ্ট করতে হবে না এমনিতেই মারা যাবে। শুধু অভিনবকে আমাদের দেখে রাখতে হবে।”

“ইউ আর ব্রিলিয়ান্ট রা’দ।”

রা’দ মাথা ঝুকে বলল,”থ্যাঙ্কস।”

জলপরী করুন চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখটা খোলা কারণ এখন কথা বলার শক্তিটুক নেই ওর। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তেছে। কোমল দেহখানা নেতিয়ে পড়েছে। ফর্সা শরীর আস্তে আস্তে আরো ফর্সা হয়ে উঠছে। শরীরে রক্ত না থাকলে যেমন শরীর সাদা হয়ে যায় ঠিক সেরকম। ওরা তিনজন জলপরীর দিকে তাকিয়ে আছে। এখন ওদের এই জলপরীর জন্য কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এখন কিছু করার নেই। অভিনবকে বাঁচাতে হলে যে জলপরীকে মারতেই হবে।রা’দ জলপরীকে বলল,”আ’ম সরি আমার কিছু করার নেই। দ্যা বুক এর অভিশাপ আর অভিনবকে বাঁচাতে হলে তোমাকে মরতে হবে।”

জলপরী ফ্যালফ্যালিয়ে রা’দের দিকে তাকিয়ে রইল। এমন সময় অভিনব পিকআপ থেকে নেমে এলো। মাথায় হাত দিয়ে সামনে এগিয়ে এসেই দেখল যে বিরাট একুরিয়ামের মধ্যে জলপরী পড়ে আছে। অভিনব দৌড়ে গিয়ে একুরিয়ামের কাঁচের গায়ে হাত রেখে বলল, “একি তোমার কি হয়েছে?? এখানে এলে কিভাবে??কে এনেছে তোমাকে এখানে?? তোমার নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে??রা’দ ওকে এখানে কেন রেখেছিস বের কর না??”

অভিনবের কথায় রা’দ কিছু বলল না। রা’দকে চুপ থাকতে দেখে অভিনব বলল,”কি হলো রা’দ??আচ্ছা তোকে কিছু করতে হবে না আমি সব করছি।”

অভিনব চারপাশে কিছু একটা খুজতেছে।রা’দ পূর্ণাশা আর লাবন্যর দিকে তাকিয়ে বলল,”আমাদের এখন অভিনবকে থামাতে হবে নয়তো ও জলপরীকে ছাড়ানোর চেষ্টা করবে।”

লাবন্য ও পূর্ণাশা মাথা দোলায়। রা’দ ব্যাগ থেকে ইনজেকশন বের করলো। পূর্ণাশা আর লাবন্য অভিনবের দিকে এগিয়ে গেল। লাবন্য বলল,”অভিনব তুই চিন্তা করিস না আমি ওই মেয়েটাকে এখনই বের করে দিচ্ছি।”

অভিনব লাবন্যর দিকে তাকিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি দে ওর যে খুব কষ্ট হচ্ছে।”
পূর্ণাশা অভিনবকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,”আগে তুই শান্ত হয়ে দাঁড়া। আমার দিকে তাকা,,,,??”

এভাবে ওরা অভিনবকে কথার ছলে ভোলাতে লাগলো। তার মধ্যেই রা’দ অভিনবকে ইনজেকশন পুশ করে দিলো। অভিনবের মাথাটা ঝিম ধরে উঠলো। হাটু ভেঙে বসে পড়লো সাথে সাথে পূর্ণাশা আর লাবন্য অভিনবকে আঁকড়ে ধরে। অভিনব ঝাপসা চোখে জলপরীর দিকে তাকালো। আগের মতোই স্নিগ্ধ হেসে হাত বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে জলপরী। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তেছে তার। হয়তো এখন সবটা দেখতে পাচ্ছে?? জলপরী অস্ফুট স্বরে বলল,”এটাই আমাদের শেষ দেখা প্রিয়। সবাই ভালোবাসলেও পাওয়ার ক্ষমতা সবার নেই। এই পৃথিবীটা তোমাকে আমাকে একসঙ্গে দেখতে চায় না।তাই আমাকে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।”

জলপরী আর কিছু বলল না। বলার শক্তি টুকু পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। অভিনবকে তার শেষ কথাটুকু বলার জন্যই বোধহয় এতক্ষণ শক্তি ছিল। কিন্তু এখন তা একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। জলপরীর দিকে তাকিয়ে আছে অভিনব। চোখের কোণে পানি জমে গিয়েছে। চোখের পাতা ফেলতেই পানি গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু অভিনব আর তাকালো না। চোখের পাতা যে ভিশন ভারি হয়ে উঠেছে। জলপরী ও চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। দুটি ভিন্ন রকমের মানুষের ভালোবাসা এভাবেই শেষ। দুজনেই চোখ বন্ধ করেছে। একজন চোখ খুলবে আরেকজন চোখ আর খুলবে না। সে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে।

পূর্ণাশা অবাক হয়ে বলল,”ওই জলপরী এভাবে বলল কেন?? তার মানে জলপরী কি সত্যি অভিনবকে ভালোবাসতো।”

রা’দ পকেটে হাত গুজে বলল,”হয়তো তাই। কিন্তু অভিনভকে কাছে পেলে তো ও ভায়োলেন্স হয়ে যেতো। অভিশাপের কারণে অভিনভের উপর আক্রমণ করতো।”

লাবন্য বলল,”আমার খুব খারাপ লাগছে জলপরীর জন্য।”
রা’দ কটাক্ষ করে বলল,”এসব এখন না ভেবে নিজেদের কথা ভাব। কারণ এরপর ওই বইতে আমাদের তিনজনের মধ্যে যেকোন একজনের গল্প লেখা হবে। তাই আগে থেকেই স্ট্রং হ।”

পূর্ণাশা শুকনো ঢোক গিলে বলল,”এরপর কার গল্প লেখা হবে??”
লাবন্য বলল,”কি জানি?? তবে আমাদের এবার সাবধান থাকতে হবে।”

আর কেউ কারো সাথে কথা বলল না।জলপরীকে ওখানে রেখেই ওরা অভিনভকে নিয়ে চলে গেল। অভিনবকে আবারও হসপিটাল এডমিট করা হলো। তবে এবার অভিনব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠছে। অভিনবকে হসপিটালে এডমিট করার পরদিন ওরা জয়দেবপুর যায়। গিয়ে দেখতে পায় জলপরীর গায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। লেজের কিছু কিছু জায়গায় পচন ধরেছে। প্রচুর গন্ধ বের হচ্ছে। তারমানে জলপরী ডাঙায় থাকতে না পেরে মারা গেছে। কিন্তু আশ্চর্য এত তাড়াতাড়ি পচন ধরলো কেন??তা রা’দ বুঝতেও পারলো না। ওরা তাড়াতাড়ি জলপরীর বডিটা সেই নদীতে ফেলে দিলো।
শেষে হয়ে গেল একটা গল্প। কিন্তু এখনও যে তিনটা গল্প বাকি আছে। ওরা কেউ জানে না যে এরপর কোন ভয়ংকর আত্মা ওদের সামনে আসতে চলেছে। তার জন্য ওরা আগে থেকেই প্রস্তুত হতে চাইছে। কিন্তু অজানা এক ভয় ওদের ভেতর জেঁকে বসেছে। ওরা কি আদৌ বাঁচতে পারবে??নাকি মরতে হবে??

পেরিয়ে গেছে সাতদিন। এই সাতদিনের মধ্যে অভিনব পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে। আগের মতো আর জলপরীর খোঁজ করে না। এটা দেখে লাবন্য রা’দ পূর্ণাশার ভালোই লাগছে। কিন্তু অভিনব যেন কেমন হয়ে গেছে??আগের মতো তেমন কোন কথা বলে না। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতে দেখা যায় না অভিনভকে। রা’দ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না কারণ আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন ওর ভাবনা যে আবার ওই বইটা পড়তে হবে এবং পরের গল্প কি তা দেখতে হবে।

চলবে,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here