বেসামাল_প্রেম #জান্নাতুল_নাঈমা #পর্ব_৬১

0
633

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৬১

ঢাকার সেই ফ্ল্যাটে দ্বিতীয়বারের মতো পা রাখল হৈমী। বিয়ের পর যেখানটায় রুদ্রর সঙ্গে গুটিকয়েক মাস কাটিয়েছিল সে। তৈরি করেছিল দুষ্টু, মিষ্টি অনুভূতিপ্রবণ একরাশ স্মৃতি। ভেবেছিল, এসেই তাকে সংসার গুছানোর কাজে লেগে পড়তে হবে৷ কিন্তু রুদ্র তার জন্য কোনো কাজই বাকি রাখেনি। বন্ধু এবং কাজের লোক দিয়ে সব কাজই সেরে ফেলেছে। বেডরুম সাজিয়েছে তাজা তাজা ফুল দিয়ে। বিশাল বেডরুমের একপাশে তাদের বিছানা। যেমনটা পূর্বেও ছিল। পার্থক্য শুধু এটাই আগে যেখানটায় ডিভান রাখা ছিল সেটা এখন আর নেই। এর পরিবর্তে সেখানে আনা হয়েছে বাচ্চাদের জন্য দু’টো নরম তুলতুলে দোলনা জাতীয় বিছানা। সবকিছুতে দৃষ্টিপাত করে লাজুক হাসল হৈমী৷ মনে মনে ভাবল, পরিবর্তন তো হবেই। তার আর রুদ্রর জীবনেও তো পরিবর্তন এসেছে। দুজনার সংসারে আরো দু’জনের আগমন ঘটেছে। তাদের সন্তান রুদ্রিক, রুদবা। এই দুটো প্রাণ তাদের সবকিছু জুড়েই থাকবে এখন৷ সকাল শুরু হবে এদের দুজনকে নিয়ে, রাত শেষও হবে এদের দু’জনকে নিয়ে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাচ্চাদের খাবার গরম করল হৈমী। রুদ্র বসার ঘরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে রুদ্রিক, রুদবাও তাদের কাছেই। এই সুযোগে কাপড় ছেড়ে রান্নাঘরে চলে এলো হৈমী। আসার পথে রুদ্র জিজ্ঞেস করেছিল,

-” কী করবে? আমরা আজ বাইরে থেকে খাবার এনে খাব। ”

হৈমী কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলল,

-” আমাদের খাবারের চিন্তা আমি করি না৷ বাচ্চারা খাবে কী? ওদের তো আর বাইরের খাবার দিব না৷ এমনিতেই খেতে চায় না। দশমাস হয়ে গেছে এখনো মেয়েটাকে ভাত খাওয়াতে পারলাম না৷ ছেলেটা যাও মুখে তুলে মেয়েটা একেবারেই তুলে না। এই চিন্তা কি আপনার আছে? থাকবে না তো সব চিন্তা শুধু আমার। আমার একার বাচ্চা যে! ”

-” অ্যাঁই মেয়ে অ্যাঁই, তথাকথিত বউদের মতো এভাবে ঝগড়া করছ কেন? সহজভাবে প্রশ্ন করেছি না আমি? ”

সহসা রুদ্র চটে যাওয়ায় হকচকিয়ে গেল হৈমী। আশপাশে তাকিয়ে সুড়সুড় করে চলে গেল রান্নাঘরে৷ রুদ্রর বন্ধু আবির ঠোঁট টিপে হাসল। বলল,

-” আহারে বেচারিকে ধমক দিলি কেন? ভালোই তো লাগছিল। ”

-” তোর ভালো দিয়ে আমার কী কাজ? ”

আবির আর কথা বাড়ায়নি। সময় অনুযায়ী খাবার চলে এলে সকলে এক সঙ্গে খেয়ে চলে গেল। রুদ্র ওদের এগিয়ে দিতে গেলে হৈমী বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দিল বিছানায়। এরপর ঝটপট সাদা কাগজ, কলম নিয়ে লিখতে বসল,

অ্যাঁই যে মিস্টার রুদ্রিক, রুদবার বাবা,
কথানুযায়ী বাচ্চাদের রেখে আমি চললাম। এবার নিজের বাচ্চা নিজেই সামলান। খুব তো বড়াই করে বলেছিলেন৷ ওরা জন্মানোর পর আমাকে ডিভোর্স দেবেন। আমি বেশ বুঝে গেছি আমাকে ডিভোর্স দেয়া আপনার সাহসে কুলোবে না। দ্যা গ্রেট রুদ্রর আজকাল বড্ড সাহসের অভাব। তাই ডিভোর্স বিহীন আপনাকে ত্যাগ করে আমি চলে গেলাম৷ এবার দেখুন, কেমন লাগে। রাগের মাথায় মুখ দিয়ে যা খুশি তাই বলার ফল এবার ভোগ করুন৷

ইতি,
রুদ্রিক, রুদবার আম্মু।

চিঠি লিখে স্বস্তি ভরে শ্বাস ফেলল হৈমী। কয়েক পল নিশ্চুপ বসে থেকে মুচকি হাসল৷ সেদিন তার মন খুবই বিক্ষিপ্ত ছিল। অ্যাবর্শন করার মতো ভুল পথ বেছে নিয়েছিল সে৷ রুদ্রর ভয়ে। সেই ভয়কে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিয়েছিল রুদ্র৷ পাশাপাশি তাকে ভুল পথ থেকেও ফিরিয়ে এনেছিল। বাঁচিয়েছিল তাদের সন্তানদের।

এ পর্যন্ত ভেবেই দোলনায় ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাদের দিকে তাকাল হৈমী৷ ওঠে গিয়ে ওদের কপালে চুমু খেল স্নেহভরে৷ শ্বাস নিল বুকভরে। এরপর স্মরণ করল সেই দিনটাকে। যেইদিন রুদ্রর থেকে তীব্র আঘাত পেয়ে খালাত বোন টিশাকে ফোন করেছিল সে৷ হাউমাউ করে কেঁদেছিল নিজের বীভৎস জীবন বিবৃতি দিয়ে। টিশা তাকে বুঝিয়েছিল। রুদ্রর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল৷ কিন্তু ধীরেধীরে যখন রুদ্রর পরিবর্তন হৈমীর নজরে এলো তখন সে আবারো টিশার সাহায্য চাইল। রুদ্রকে হৈমী ভালোবাসে। সবকিছুর পর তারা স্বামী- স্ত্রী। তাদের দু’টি মাসুম বাচ্চা রয়েছে। এছাড়া সম্পর্ক ভাঙ্গন, পরিবার ভাঙ্গন কখনো সমাধান হতে পারে। দু’টো মানুষদের যদি ভেঙে সমাধান আনতে চায় তাহলে হয়তো তারা দু’জন সুখী হবে। কিন্তু তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর জীবন হয়ে ওঠবে দুর্বিষহ। সবচেয়ে বড়ো কথা রুদ্রিক, রুদবার জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাছাড়া রুদ্র যদি নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে। হৈমী যদি একটু সময় নিয়ে অনুভব করতে পারে এই মানুষটার সঙ্গে বাকি পথ চলা সম্ভব। তাহলে নিক না সময়। টিশার বুদ্ধিতে সেই সময় নিয়েছে হৈমী। বুঝেছে মানব জীবনের গতিধারা। আমরা পুঁথিগত শিক্ষায় যতটা অর্জন করি। জীবনের পথে চলতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থানের মুখে পড়ে তার চেয়েও দ্বিগুণ অর্জন করে ফেলি। হৈমীও অর্জন করে নিল। আপাদমস্তক রুদ্রটাকেই জেনে ফেলল সে। নিজের সন্তানদের বাবাকে পড়ে ফেলল অনায়াসে। সবশেষে বুঝে নিল, যায় এই মানুষটার সঙ্গে বাকি পথ অনায়াসেই চলা যায়।

এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই পারফেক্ট হয় না। সব মানুষের মাঝেই রয়েছে দোষ, গুণ, ত্রুটি। আমরা যদি মানুষকে তাদের দোষগুণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই। ত্রুটি গুলো চিহ্নিত করে দিই। তাহলে হয়তো মানুষটা নিজের ভুলগুলো বুঝে এক সময় ঠিক শুধরে যাবে।

হৈমী পুনরায় ফিরে এলো বিছানায়। ফুলে সজ্জিত বিছানায় হাত বুলিয়ে আরো একটি চিঠি লিখতে বসল,

শুনুন,
আপনার এই ফুলশয্যাও আমি ত্যাগ করলাম৷ কেন জানেন? ইতিপূর্বে যে ভুলগুলো করেছেন তার জন্য আপনি আমার কাছে একটা সরিও বলেননি। বলবেন কেন? আপনি তো একজন ইগোয়েস্টিক পার্সন। আচ্ছা আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন আমার পাশে আপনাকে মানায় না৷ কীভাবে মানাবে? বলুন কীভাবে মানাবে? আপনি তো একটা বটগাছ! বটগাছের সাথে কি আর ডালিম গাছ যাবে? না কক্ষনো যাবে না। আমি হচ্ছি সহজসরল ভোলা ভালা একটা মেয়ে। আমার মধ্যে অহংকারের ‘অ’ও কেউ খুঁজে পাবে না৷ আর আপনি অহংকারের অ, হ, ং, ক, র সবই লালন, পালন করে বড়ো হয়েছেন। নাহ এভাবে হয় না। ওহ হ্যাঁ মোস্ট ইম্পর্টেন্ট বিষয় তো লিখলামই না৷ লিখছি…
অ্যাঁই আপনার সমস্যা কী। আমাকে বিয়ে করে দুটো বাচ্চার মা বানিয়ে ফেলেছেন। অথচ… আজ পর্যন্ত একটা বার আই লাভ ইউ বলেননি। আমার তো খুব দুঃখ হচ্ছে এই ভেবে, যে লোকটার দু’টো সন্তানের মা আমি৷ সেই লোকটা এখন পর্যন্ত আমাকে আই লাভ ইউই বলেনি। ছিঃ ছিঃ ছিঃ নিজের ওপর ছিঃ আসছে। কীভাবে সম্ভব এটা কীভাবে? নাহ আমি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকব না। আপনার মতো ইগোয়েস্টিক, রসকষহীন জামাই আমার দরকার নেই।

ইতি,
আপনার নিরহংকারী বউ।

চলবে…
বর্ধিতাংশ অর্থাৎ শেষ অংশ পরের পর্বে দিব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here