আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ #মাইশাতুল_মিহির [পর্ব-১০]

0
1738

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-১০]

আষাঢ়মাসের সপ্তম দিন আজ। তিমিরাচ্ছন্ন পরিবেশে শীতল হাওয়া প্রভাহমান। রাস্তাঘাটের গর্ত ভর্তি বৃষ্টির পানি। বারান্দায় লাগানো ফুল গাছ গুলো ভিজে আছে বৃষ্টির পানিতে। সদ্য ফোটা বেলীফুলের ঘ্রাণে পুরো বারান্দা মুমু করছে। শেষ রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ভোরের পরিবেশটা আজ স্নিগ্ধ, কোমল। রেলিং’য়ে দুইহাতের ভর দিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা ভোরের দৃশ্য দেখছে দীবা। হঠাৎ মনে হলো এক কাপ চা হলে কেমন হয়? যদিও প্রতিদিন সকালে সাত টায় সবাইকে চা দেওয়ার দায়িত্ব দীবার। এখন ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। তাই নিজের জন্যই চা বানাতে রুম থেকে বের হলো। আবরারের রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় খেয়াল করলো রুমের দরজা হাল্কা খোলা। কৌতুহলবশত উঁকি দিলো রুমের ভিতরে। না কেউ নেই। ফুঁশ করে নিশ্বাস ফেললো। কেমন চোর চোর লাগছে নিজেকে। পাশের বাসার আন্টিরা যেমন অন্যের বাড়ি উঁকিঝুঁকি মারে ঠিক তেমনি লাগলো ব্যাপার টা তার কাছে। ভেবেই নিশব্দে হেসে ফেললো। চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ভরকে গেলো দীবা। তার ঠিক পেছনেই আবরার দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে দীবা বুকে হাত রেখে জুড়ে জুড়ে কয়েকবার নিশ্বাস নিলো। তারপর ভয়ার্ত চোখে তাকালো আবরারের দিকে। আবরার চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে দীবার দিকে। এই মেয়ে এতো ভয় পায় কেন? আর রুমের ভিতরে উঁকি দিয়ে কি দেখছিলো? ভয়ে দীবা শুকনো ঢুক গিললো। আড় চোখে আশেপাশে একবার তাকালো। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আবরার ধমকে উঠলো, ‘খবরদার পালাবে না!’

ধমক শুনে ভয়ে চুপসে গেলো দীবা। দাঁড়িয়ে পরলো তাৎক্ষনাৎ। ঘন চোখের পাপড়ি ফেলে পিটপিট করে তাকালো আবরারের দিকে। দীবার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে আবরারের। আর এখন যেহেতু হাতের কাছে পেয়েছে, সেহেতু একটু হ্যানস্তা করা-ই যায়। এই কয়েকদিন দীবা আবরারকে দেখলেই পালাই পালাই করেছে। গতকাল সকালে তো বাগান থেকে আবরার কে দেখে দীবা এমন ভাবে দৌড়ে চলে গেছে সবার সামনে যেন আবরার ধরতে পারলে খেয়ে ফেলবে তাকে। অথচ দীবাকে দেখার জন্য দুপুরে ঘুম থেকে উঠা ছেলেটা ভোরে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর দীবার তাকে নিরবে উপেক্ষা করে। তার এমন আচরনে রাগ হয়েছে আবরারের। সে তো একটু দীবাকে দেখার আশায় ব্যাকুল থাকতো। মেয়েটাকে দেখতে তার ভীষণ ইচ্ছে করে। তাহলে দীবা তাকে দেখলে এমন কেন করবে? এই কয়দিনে আবরার খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছে যে দীবাকে তার চায়। মানে দীবাকে তার লাগবেই।

‘সমস্যা কি তোমার?’

পকেটে দুই হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো আবরার। দীবা পিটপিট করে তাকিয়ে শুকনো ঢুক গিলল। আমতা আমতা করে মিনমিনে গলায় প্রত্যত্তর করলো, ‘কোনো সমস্যা নেই।’

‘তাহলে আমাকে দেখলে পালাও কেন? আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক? খেয়ে ফেলবো তোমায়?’ রুক্ষভাষী কন্ঠে বলে উঠলো আবরার। ধাতস্থ হলো দীবা। আড় চোখে আবরারের দিকে তাকালো। মনে মনে ভাবছে সে কিভাবে এখান থেকে পালাবে। দৌড় দিয়ে নিজের রুমে যাবে? নাকি নিচে? দৌড় দিলে যদি হাত ধরে ফেলে? নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো দীবা। রুম থেকে বের হওয়া মোটেও উচিত হয়নি তার। দীবাকে চুপ থাকতে দেখে আবরার আবারো শক্ত গলায় বললো, ‘উত্তর দাও!’

‘না, মানে এমনি।’ শুকনো ঢুক গিলে বললো দীবা। ভয়ে শরিরে মৃদু কম্পমান বিরাজ করছে তার। আবরার দীবার অবস্থা দেখে মনে মনে হাসলো। আরো ভয় দেখানোর জন্য দীবার দিকে এক কদম এগিয়ে এলো। দীবা যেন এবার আরো গুটিয়ে গেলো। চোখ বড়বড় করে তাকালো আবরারের দিকে। পিছনে দরজা থাকায় দীবা পিছাতে পারলো না। আবরার বললো, ‘নেক্সট টাইম আমাকে দেখে পালানোর চেষ্টা করবে না। নাহলে কোলে তুলে বসিয়ে রাখবো। গট ইট?’

আহাম্মকের তাকিয়ে রইলো দীবা। কথাটা বলেই আবরার দীবাকে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেলো। ভিতরে গিয়ে দরজাটা ধিরিম করে লাগিয়ে দিলো। বিস্ময়ের কারণে দীবার মুখ কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আছে। এটা কি বললো? কোলে তুলে বসিয়ে রাখবে মানে? হতভম্ব হয়ে পিছু ফিরে দরজার দিকে তাকালো। আবরারের কথাটা ভাবতেই মুহূর্তেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো দীবা। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দ্রুত নিজ কক্ষে চলে গেলো সে।
________________

গতকাল সকালের মতোই আজ সকালে কলেজে যাওয়ার আগে ওয়াশরুমে বসে ছিলো দীবা। নাস্তার টেবিলে কিছুতেই যাবে না সে। আবরারের মুখামুখি হওয়ার চেয়ে বাথরুমে বসে থাকা ভালো। যেই ভাবা সেই কাজ! কলেজ ড্রেস পরে ওয়াশরুমে বসে রইলো। নাস্তার সময় শেষ হলে বের হবে। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? রিমি ও নুরা তৈরি হয়ে দীবার রুমে আসলো এক সাথে নাস্তা করবে ভেবে। পুরো রুম জুড়ে দীবাকে না পেয়ে ওয়াশরুমে নক করলো। সন্দেহ মোতাবেক গতকালের মতো আজও নাস্তা না করার জন্য দীবা ওয়াশরুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বিরক্ত হলো নুরা রিমি। হাজারটা প্ল্যান বানিয়ে ঠিকই দীবাকে বের করলো। অসহায় হলো দীবা। ঠোঁট উলটে কাদুকাদু চেহারায় তাকিয়ে রইলো শুধু। রিমি নুরা দুজন দীবার দুই হাত ধরে জুরপূর্বক টেনে নিচে নিয়ে এলো। ডাইনিং টেবিলের কাছে আসার পর রাইমা তাদের দেখে অবাক হয়ে তাকালো। তারপর খাবার মুখে নিয়ে বলে উঠল, ‘কি হইছে? এভাবে আসার কারণ কি?’

নুরা ফিশফিশ করে দীবার কানে কানে বললো, ‘তুই যে কালকের মতো আজকেও বাথরুমে সংসার পেতেছিস। বলবো?’

পাশ থেকে রিমিও নিচু আওয়াজে বলে উঠেলো, ‘আরেকটু দেড়ি হলে বাচ্চা ফুটিয়ে ফেলতো।’

বিরক্ত হলো দীবা। দুজনের দিকে কড়া চোখে তাকালো। দাঁত কিড়মিড় করে বললো, ‘অসভ্যের দল!’

চাপা শব্দে হাসলো নুরা। দীবার দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ নাচালো। অতিরিক্ত হতাশ হয়ে বিরক্তির নিশ্বাস ছুড়লো দীবা। চোখমুখ কালো করে রাইমার পাশের চেয়ার টেনে বসে পরলো। মুখ ফুলিয়ে খাবার খাওয়া শুরু করলো দীবা। এতোক্ষণে আবরার দীবার দিকে চোখ তুলে তাকালো। কলেজ ড্রেস পরা মেয়েটিকে দেখে আবরার আরেকবার খোঁচট খেলো। বেনী করা চুল দুই পাশে এনে রেখেছে। গোলগাল চেহারায় অতিরিক্ত কিউট লাগছে। চোখ সরানো কষ্টসাধ্য হয়ে পরেছে আবরারের। আবার সরাসরি তাকিয়েও থাকতে পারছে না। তাই বারবার আড় চোখে দীবার দিকে তাকাচ্ছে সে। অনিচ্ছা থাকা শত্বেও চোখ দীবার দিকে চলে যাচ্ছে। দীবা খুব দ্রুততার সাথে খাবার খেতে লাগলো। এখানে বসে থাকতে তার অস্বস্তি লাগছে। লোকটা সকালে কি বললো? মনে পরতেই আরো আড়ষ্টভাব আসলো তার মাঝে। খাওয়ার মাঝেই হঠাৎ সামনে তাকাতেই আবরারের চোখের সাথে চোখ মিলে গেলো। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আববার। তাৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিলো দীবা। এবার যেনো অস্বস্তি আরো বেড়ে গেছে। এভাবে তাকিয়ে কি দেখছিলো লোকটা? মনে আবরারকে বেহায়াদের তালিকায় ফেলে দিলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাবার শেষ করে যেতে পারলেই বাঁচে।

‘আস্তে খা, নয়তো খিচকি উঠবে।’

দীবার উদ্দেশ্যে বললো আরিয়ান। দীবা প্রত্যত্তরে কিছু না বলে ধীরে স্বস্থিতে খেতে লাগলো। রিমি ভ্রুঁ কুঁচকে আরিয়ানকে বলে উঠল, ‘বাহ বাহ, এখানে তো শুধু দীবাই তোমার বোন। ‌আঁরা তো ফেনালল্ব ভাসি আ‌ইশ্যি!’

আরিয়ান ত্যাছড়া কন্ঠে উত্তরে বললো, ‘হ্যাঁ তোকে তো চন্দ্রনাথ পাহাড়ের নিচ থেকে কুঁড়িয়ে এনেছে। জানিস না?’

অভ্র ফিক হেসে ফেললো আরিয়ানের কথা শুনে। কোনো রকমে হাসি আটকে সামনে তাকিয়ে দেখলো রিমি তার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আছে। অর্থাৎ হাসার অপরাধে তাকে চোখ দিয়ে জ্বালিয়ে দিবে। রিমির এমন চাহনীতে অভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। পরোক্ষনে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেসে খাবারে মনোযোগ দিল। খাওয়া দাওয়া শেষে ছেলেরা সবাই ড্রয়িংরুমে বসে পরিকল্পনা করছিলো কোথায় ঘুরতে যাবে তা নিয়ে। তখন রিমি, নুরা, দীবা কলেজে যাবার জন্য ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো। আবরারের চোখ আবারো আটকে গেল কলেজ ড্রেস পরা মায়াবী মুখশ্রীর অধিকারিণীর দিকে। মেয়েটাকে ইউনিফর্মে এতো কিউট লাগছে। সে সরাসরি না তাকিয়ে কৌশলে আড় চোখে বার বার দীবার দিকে তাকাচ্ছে। এতো বছর জীবনে সে এমন বেহায়ার মতো কোনো মেয়ের দিকে তাকায় নি। আর আজ? কি বেহায়া তার মন। পরোক্ষণে আবারো ভাবলো। বউ তো তারই। সুতরাং সে সারাদিন তাকিয়ে থাকতেই পারে। তাতে কার কি?

তিন জন নিচে এসে জানতে পারলো আরিয়ান বাহিরে ঘুরতে যাবে আবরার আর অভ্রকে নিয়ে। তাই রিমি বলে উঠল, ‘তোমরা ঘুরতে যাবে তাহলে আমরাও যাবো। অনেক দিন ঘুরতে যাওয়া হয় না।”

দীবা রিমির হাত টেনে গলার আওয়াজ নামিয়ে বললো, ‘আল্লাহ চুপ কর, যেতে হবে না।’

রিমি চোখ পাকিয়ে তাকালো দীবার দিকে। দাঁত কটমট করে বললো, ‘বেশি কথা বলিস না। সুযোগ বার বার আসে না।’ তারপর আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে উল্লাসিত গলায় বললো, ‘আমরা গেলে সমস্যা হবে ভাইয়া?’

আবরার চুপচাপ বসে রইলো। আরিয়ান রিমির সাথে সম্মতি দিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ চল, সমস্যা নেই।’

নুরা তাৎক্ষনাৎ নাঃকোচ করে বলে উঠল, ‘না না, আজকে ফিজিক্স ক্লাস আছে। যেতে পারবো না।’

দীবা রিমি চোখ বড় বড় করে তাকালো নুরার দিকে। যেই মেয়ে ফিজক্স শব্দ টাকেই ভয় পেতো সেই মেয়ে কেনো আজ ফিজিক্স ক্লাস করতে এতো এক্সাইটেড তা এক মাত্র রিমি আর দীবা জানে। তাই তো নুরার কথায় অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দুজন। নুরা কিছুটা হকচকিয়ে গেলো তাদের এমন চাহনীতে। হাল্কা আওয়াজে ইতস্ততবোধ করে বললো, ‘এভাবে হায়ানার মতো কি দেখছিস? খেয়ে ফেলবি নাকি?’

রিমি লম্বা হাই তুলে বললো, ‘ লাভ নেই, ছেলে হলে ভেবে দেখতাম।’

দীবা নুরার দিকে চোখ ছোট ছোট করে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘তুই ক্লাসের জন্য ঘুরতে যাওয়া ক্যান্সেল করছিস? তাও আবার ফিজিক্স ক্লাসের জন্য?’

নুরা কিছুটা বিব্রতবোধ করে বললো, ‘সামনে এক্সাম। পড়ায় কনসেন্ট্রেট দে। হুদাই কেন টাইম ওয়েস্ট করবি?’

রিমি কিছুটা কূটস্থ করে বললো, ‘হ্যাঁ আপনার কনসেন্ট্রেট মানে চোখ দিয়ে আরেক জনকে গিলে ফেলা।’

রিমির কথায় দীবা মুখে হাত দিয়ে শব্দ করে হেসে ফেললো। এই হাসিতে যেন আবরার আবার মুগ্ধ হলো। মেয়েটির হাসি টাও মারাক্তক সুন্দর। হায়! এটা তো অনেক সাংঘাতিক একটা ব্যাপার।

তিনজন কে এভাবে ফিশফিশ করতে দেখে আরিয়ান ভ্রুঁ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি পটরপটর করছিস?’

দীবা নুরা এক সাথে ‘কিছু না!’ বলে বেরিয়ে গেলো। রিমি যাবার আগে অভ্রের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে মারলো। তারপর হনহন পায়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। অভ্র হতভম্ব হয়ে গেলো রিমির এমন চাহনীতে। এভাবে তাকানোর মানে কি? বেচারা কিছু বুঝতে না পেরে বোকা বনে গেলো কেবল।

চলমান..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here