#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-১১1]
বিকেলে বাড়ির পিছনের লনের দিকে হাঁটছে অভ্র। এখানে এসেছে আজ কয়েকদিন হলো। কিন্তু বাড়ির আশেপাশে ঘুরে দেখা হয়নি তার। এখানে আসার পর থেকেই আরিয়ানের সাথে প্রতিদিন বাহিরে ঘুরাঘুরি করেছে। তবে আজ বিকেলে অবসর। বাহিরে ঘুরতে যাবে না তারা। তাই এই অবসর সময় কাটাতে বাড়ির পিছনের দিকে আসা। দুপুরে ঝুম বৃষ্টি হওয়ায় বাড়ির আনাচে কানাচে ভিজে টুইটুম্বুর হয়ে আছে। কাঠের তৈরিকৃত ব্যাঞ্চিগুলো ভিজে একাকার। লনের এক পাশে নিশিতা আর আয়েশা নিজেদের হাতে যত্ন সহকারে বিভিন্ন সবজি লাগিয়েছে। সেগুলোও বর্ষণে ভিজে আছে। যার সদ্য কচি পাতা থেকে টুপটুপ পানি ঝরছে। শীতল বাতাসে গাছের পাতা নড়বড়ে। কর্দমাক্ত মাটিতে হাঁটার সময় একটা ইটের টুকরো তে খোঁচট খেলো অভ্র। বিরক্ত হলো কিছুটা। ঝুকে ইটের ভাঙ্গা টুকরো টা হাতে নিয়ে দূরে ছুড়ে মারলো। তখুনি পাশ থেকে একটা মেএয়েলী কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।
‘হেই ইউউউ!’
রিমির রাগান্বিত কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই অভ্র পিছে ফিরে তাকালো। রিমির অবস্থা দেখে বিস্মিত হলো বেশ। তবে ভীষণ হাসি পেলো তার। হাসি আটকাতে না পেরে তাৎক্ষনাৎ হুহা করে হেসে ফেললো। কারণ রিমির সাদা জামা কাদায় মাখামাখি অবস্থা। অভ্রকে এভাবে হাসতে দেখে রিমির রাগের মাত্রা আরো দ্বিগুণ হয়ে গেলো। ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো, ‘হাসছেন কেন আপনি?’
‘মাটির সাথে হাডুডু খেলে এসেছেন নাকি মিস সয়েল কুইন?’
রসিকতার ছলে বললো অভ্র। কিন্তু এতে রিমির রাগ আকাশ চুম্বী হলো। তার কণ্ঠস্বরে ক্রোধ প্রকাশ করে শুধালো, ‘হাউ ডেয়ার ইউ? আমাকে সয়েল বলার সাহস হয় কি করে আপনার? নিজে আমার গায়ে কাদা ভরিয়ে আবার বলছেন আমি হাডুডু খেলছি?’
তাৎক্ষনাৎ ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে এলো অভ্রের। কপালে সরু ভাজ ফেলে জানতে চাইলো, ‘আমি ভরিয়েছি মানে?’
রিমি কন্ঠ ব্যাঙ্গ করে বললো, ‘এহেহে, ঢং করছেন এখন? ইট দিয়ে ঢিল কে মা*র*লো? ভূতে?’
এতোক্ষণে সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝে আসলো অভ্রের। খেয়াল করে দেখলো কিছুক্ষণ আগে ছুঁড়ে ফেলা ইটের টুকরো টা রিমির পাশে পরে আছে। নিজের ভুল বুঝতে পারার পরেও অপরাধবোধ কাজ করলো না তার মনে। বরঞ্চ উলটো নিজের সাফাই গেয়ে বললো, ‘আমি ইটের টুকরো রাস্তার পাশে ফেলেছি। তুমি ওখানে কি করছিলে? তোমার সাবধানে থাকা উচিত ছিলো।’
রিমি কোমড়ে হাত রেখে ত্যাঁছড়া গলায় বললো, ‘দোষ করছেন আপনি আবার সাফাই গাইছেন? চোখ কি আকাশে ছিলো? পাশে একটা আস্তো জ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলো। দেখেন নাই?’
অভ্র নিজেও ত্যাঁড়া ভাবে বললো, ‘চোখ সাথেই ছিলো। আর আমার কোনো দোষ নেই ওকে? মশার মতো শরির হলে দেখবো কিভাবে?’
‘কি বললেন? আমাকে মশার সাথে তুলনা করলেন? এতো বড় অপমান? আপনাকে তো আমি….’ অতিরিক্ত রাগের মাথায় উত্তেজিত হয়ে উঠলো রিমি। অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। অভ্র চোখ ছোট ছোট করে রিমির মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছে। কি করতে চাইছে মেয়েটা? সবজি গাছের পাশে ছোট একটা প্লাস্টিকের বল ছিলো যেখানে কাদা মাটি রাখা। রিমির এগিয়ে বল হাতে নিয়ে অভ্রের দিকে ছুঁড়ে মারলো তাৎক্ষনাৎ। মুহূর্তেই অভ্রের অবস্থা কাদা ভরে খারাপ হয়ে গেলো। আকস্মিক ঘটনায় অভ্র হতভম্ব হয়ে গেলো। কণ্ঠস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে উঠলো, ‘এটা কি হলো?’
রিমি দাঁত কেলিয়ে হাসলো। কর্দমাক্ত পাতিলটা পাশে ফেলে দিয়ে বললো, ‘পাটকেল দিলাম!’
অভ্রের রাগ হলো প্রচুর। চোয়াল শক্ত করে ধমক দিয়ে বলে উঠলো, ‘হুয়াট দ্যা হেল! এমন বাচ্ছামো করার মানে কি?’
অভ্রের ধমক শুনে রিমি কিছুটা ভরকে গেলো। কিন্তু প্রকাশ না করলো না। উল্টো কড়া চোখে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ্য করে বললো, ‘বেশ করেছি। এখন আপনাকেও সুন্দর লাগছে।’
অভ্র একবার নিজের দিকে তাকালো। সাদা শার্টটা কাদায় একদম মাখামাখি অবস্থা। সারা কাপড় থেকে কাদার দাগ উঠানো অনেক কষ্ট! আবার মাঝে মাঝে উঠেও না। যদি এই শার্টেরও না উঠে? ক্রোধান্বিত হলো অভ্র। প্রিয় শার্টের এমতাবস্থা দেখে রিমির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠলো, ‘শার্টের দাগ যদি না উঠেছে তাহলে তোমার বারোটা বাজাবো আমি।
রিমি বুড়ো আঙ্গুল টা দেখিয়ে দিয়ে ভেংচি কেটে বলল, ‘কচু করবা তুমি।’
চলেই গটগট পায়ে চলে যাবার জন্য পা বাঁড়ালো। অভ্র রাগে ক্ষোভে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। মেয়েটাকে একবার হাতের কাছে পেলে বুঝিয়ে দিবে মজা। রাগে ফুঁশ করে একটা নিশ্বাস ফেলে রিমির পিছু হাঁটতে লাগলো।
বিকেলের শেষভাগে অর্থাৎ সন্ধ্যা বেলায় শান্তি নিবাসে আড্ডার আসর বসে। কিন্তু আজ সেই হাসি শব্দ নেই আড্ডায়। কারণ পরিবারের ছোটরা এই আসরে অনুপস্থিত। রয়েছে শুধু বড়রা। নিশিতা একটা বড় কাথা নিয়েছে। সেই কাথা-ই সেলাই করছে নিশিতা, আয়েশা ও রোহানা। কাথা সেলাই করছে ও কথা বলছে। তাদেরই কথোপকথনের সঙ্গি হচ্ছে আবরার। সিঙ্গেল সোফায় হেলান দিয়ে বসে মা-চাচির কথা শুনছে, মাঝে মাঝে নিজেও কথা বলছে ও হাসাহাসি করছে।
রিমি নিজের গায়ে এমন কর্দমাক্ত অবস্থা দেখে নিজেরই ঘিনঘিন লাগছে তার। নিজেকে পরিষ্কার করার দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির ভিতরে আসলো। ড্রয়িংরুমের সোফায় তাদেরকে বসে থাকতে দেখে ধাতস্থ হলো রিমি। কিছুতেই নিজের এমন অবস্থা তাদের দেখানো যাবে না। নিশিতা দেখলে তো বকাবকি শুরু করবে। তাই চুপিচুপি পায়ের কদম ফেলে সিঁড়ির দিকে যেতে লাগলো। চোখ এড়ালো না আবরারের। সোফায় বসে থেকেই ডেকে উঠলো, ‘কিরে পেত্নী। শরিরের এই অবস্থা কেন তোর?’
দাঁড়িয়ে পরলো রিমি। চোখমুখ বন্ধ করে খিঁচে বিড়বিড় করে বললো, ‘শিট গার্ল!’ মহা বিরক্তি ও অস্বস্তি নিয়ে পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। আয়েশা জিজ্ঞেস করলো, ‘পরে গিয়েছিলি নাকি? ব্যাথা পেয়েছিস?’
রিমি মাথা এপাশ থেকে অপাশ নাড়িয়ে ‘না’ বুঝালো। তখুনি সদর দরজা দিয়ে ভিতরে অভ্র আসলো। রিমির মতো অভ্রের একই হাল দেখে বিস্মিত হলো সবাই। সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো অভ্র। চোখেমুখে তার অসন্তুষ্টি স্পষ্ট ভাস্যমান। রিমি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে অভ্রের দিকে। যতো যাই হোক, অভ্র বাড়ির মেহমান! আর মেহমানের সাথে এরূপ আচরণ করা অনুচিত। কিন্তু সে এমনই করেছে। এবার নিশ্চয় সবাই তার উপর ক্ষেপে যাবে। ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো রিমি।
অভ্রের এমন অবস্থা দেখে রোহানা বিস্মিত হয়ে বলে উঠলো, ‘ওমা! তোমারও দেখছি একই অবস্থা। কি হয়েছে তোমাদের? গায়ে কাদা কেন?’
অভ্র রিমির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘হাতিকে মশা বলে সম্মোধন করায় এই অবস্থা।’
রিমির মুখ সাথে সাথে হা হয়ে গেলো। তখন তাকে মশা বলেছে; আর এখন হাতি বলছে। রাগে শরির রিনরিনিয়ে উঠলো। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কিড়মিড়িয়ে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘মানে কি? তখন আমাকে মশা বলেছিলেন। আর এখন হাতি বলছেন?’
অভ্র বললো, ‘তো করবো টা কি? সত্ত্য কথা বলায় যেহেতু গায়ে কাদা ছুড়েছো। সেহেতু মিথ্যেই বলা শ্রেয়। ভুল কিছু বলেছিলাম? তোমাকে তো মশার সাথেও তুলনা করলে মশাকে অপমান করা হবে।’
রিমি অভ্রের দিকে এক হাত তুলে সবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দেখেছো আবার আমাকে মশা বলছে।’
দুজনের এমন কথোপকথন শুনে হতভম্ব হয়ে রইলো সবাই। অভ্রের এই হাল যে রিমি ইচ্ছাকৃত করেছে তা বুঝতে বাকি নেই কারোর। নিশিতা এতোক্ষণে মুখ খললো, ‘রিমি এটা কেমন অসভ্যতামি? বাড়ির মেহমানের সাথে কেমন ব্যবহার করা উচিত জানো না?’
নিশিতা অভ্রের পক্ষে কথা বলায় ভারি অবাক হলো রিমি। নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে বলে উঠলো, ‘আম্মু? উনি প্রথমে আমার জামায় কাদা ছুড়েছে। তারপর আমি দিয়েছি। এখানে আমার কোনো দোষ নেই।’
অভ্র রিমিকে বললো, ‘আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে দেইনি। তুমি ইচ্ছে করে আমার শার্টে কাদা ভরিয়েছো।’
রিমি ঝাঁঝ মেশানো গলায় বললো, ‘পাশে আস্তো একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে আর আপনি দেখেন নি? ঢং মারছেন এখন? অবশ্যই আমাকে ইচ্ছে করে দিয়েছেন। তাই আমিও দিয়েছি। এখানে দোষ আপনার। নাহলে আমি দিতাম না।’
আবরার গালে এক হাত দিয়ে চুপচাপ দুজনের ঝগড়া দেখছে। অভ্র যে এভাবে ঝগড়া করতে পারে সেটা তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। সবসময় পরিপাটি থাকা ছেলেটা আজ ঝগড়া করছে। ভাবতেই বিস্ময় লাগছে বেশ। নিশিতা মেয়ের কথা কানে নিলো না। বরঞ্চ ধমকে বলে উঠলো, ‘চুপ কর রিমি। বেয়াদবির একটা সীমা থাকে। অভ্র তোমার বড়। তার সাথে এমন আচরণ ঠিক হয়নি তোমার।’
রিমি নিজের সাফাই নিজেই গাইতে লাগলো, ‘কি ঠিক হয়নি। আমাকে বলছো কেন তুমি? এই লুজার আমাকে প্রথম দিয়েছে তাই আমি দিয়েছি।’
অভ্রকে লুজার বলে নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেলো রিমি। থমথমে হয়ে গেলো মুখখানি। ইতস্তত করে অভ্রের দিকে তাকালো। তারপর চোখ ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখলো সবাই অবাক। নিজের উপর রাগ হলো তার। মুখ ফসকে কি বলে ফেলেছে সে? আড় চোখে আবারো অভ্রের দিকে তাকালো রিমি। অভ্র চোয়াল শক্ত করে রিমির দিকে এক পলক পাকিয়ে উপরে চলে গেলো। তখুনি নিশিতা ধমকে উঠলো, ‘এইসবের মানে কি রিমি? অভ্র বাড়ির মেহমান। তোমার ভাইয়ের সাথে কাজ করে সে। এভাবে অপমান করার সাহস পেলে কোথায়? আদর পেতে পেতে মাথায় চড়ে গেছো। অভ্রের কাছে মাফ চাইবে তুমি। বেশি কথা বললে চ:ড় লাগাবো গালে।’
অতিরিক্ত রেগে কথা গুলো বললো নিশিতা। তারপর কাথা ফেলে উঠে চলে গেলো বসার রুম থেকে। আবরার চুপচাপ উঠে দাঁড়াল। রিমির কাছে এসে বললো, ‘স্যরি বলে নিস।’ বলেই উপরে চলে গেলো।রিমি হতবাক হয়ে ফুঁশ করে একটা বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে গটগট পায়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
রিমিকে কথাটা বলেই উপরে চলে আসলো আবরার। নিজের রুমের ভিতর ঢুকার সময় দাঁড়িয়ে পরলো সে। ঘাড় ঘুরিয়ে দীবার রুমের দিকে তাকালো একবার। তার রুমের পরের রুমটাই দীবার রুম। এইসময় দীবা কি করছে? দীবাকে দেখার ইচ্ছা পোষন করলো তার মন। তাই বিলম্ব না করে দীবার রুমের দিকে এগিয়ে আসলো। দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই দেখলো খোলা। তাই অতি সাবধানে দরজার এক পাশ খুলে ভিতরে তাকালো। দেখলো স্টাডি টেবিলের উপর দুই পা রেখে চেয়ারে হেলান শুয়ে আছে দীবা। হাতে তার পপকর্নের বাটি। টেবিলের উপর ল্যাপটপ রেখে ‘ইউর নেইম’ এনিমি লাগিয়ে এক মনে মুভি দেখছে আর পপকর্ন খাচ্ছে। অন্যদিকে বিন্দুমাত্র ধ্যান নেই তার। পিছন থেকে দেখলো আবরার। দীবার শুয়ে থাকার স্টাইল দেখে হাসি পেলো তার। বাচ্চা মেয়েটার প্রেমে সে এভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে। ভাবা যায় এইসব? মৃদু হাসলো আবরার। কোনো প্রকার শব্দ না করেই দরজা লাগিয়ে দিলো সে।
হঠাৎ দীবার মস্তিষ্ক সজাগ হলো। টেবিল থেকে পা নামিয়ে দরজার দিকে তাকালো। কেউ এসেছিল নাকি? কোনো প্রকার সাড়াশব্দ পায়নি দীবা। তবুও তার সিক্স সেন্স বলছে এই মাত্র রুমে কেউ এসেছিলো। কিন্তু চুপিচুপি কে আসবে? কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ পরলো দীবার। দ্রুত পপকর্নের বাটি টেবিলে রেখে চেয়ার থেকে উঠে দরজার কাছে আসলো। দরজা খুলে বাহিরে এসে আশেপাশে তাকালো। না! কাউকে দেখতে পারছে না। তাহলে কে আসলো? নাকি মনের ভুল? সন্দেহ হলো দীবার। তার মন বলছে কেউ এসেছে। কিন্তু কে? উফফ! বিরক্ত হলো নিজের উপর। চুপচাপ দরজা লাগিয়ে দিয়ে টেবিলের কাছে গেলো আবার।
চলমান…