তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি,৫,৬

0
3820

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি,৫,৬
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৫)

তাজের মুখের অশ্রাব্য ভাষাও তিহি শুনতে পাচ্ছে না। তার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে,এই চোখ সে কোথায় দেখেছে? কিভাবে ছুঁয়েছে? কিভাবে পরিচিত হয়েছে? এমন ভয়ংকর মানুষটার সাথে তার কখনও দেখা হয়নি। তাহলে তার চোখ দুটো কেন তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে? আর কিই বা বলতে চাচ্ছে? তিহি প্রচন্ড ব্যথাকে অগ্রাহ্য করে চাপা কণ্ঠে বলল,
” কে আপনি?”

এমন পরিস্থিতিতে তিহির মুখে এমন প্রশ্নে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছে তাজ। যে মুঠোর মধ্যে তিহির চুল আটকে ছিলো সেই মুঠোটাও নরম হয়ে এসেছে। তাজের মুখের রাগের ভাঁজগুলো ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে। থেমে গেছে তার অশ্রাব্য বুলি। ভয়ংকর চোখ দুটোও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তিহির দিকে তাকাতে পারছে না। মনি দুটো এদিক-ওদিক ঘুরছে ক্রমশ।

তাজের হঠাৎ এমন অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়াটা তিহিকে আরও বেশি ভাবাচ্ছে। এবার চাপা স্বরটাকে একটু খুলে নিয়ে জোর গলায় বলল,
” কে আপনি? আর আপনার এই চোখ দুটো আমার খুব চেনা। কোথায় দেখেছি আমি? আমাদের কি আগে কখনও দেখা হয়েছিল? বলুন কে আপনি?”

তিহির একের পর এক প্রশ্ন তাজের স্বাভাবিক রুপটাকে আবার অস্থির করে তুলছে। মুহূর্তেই কঠিন রুপ ধারণ করে বলল,
” আমি কে তুই জানিস না? চিনিস না আমায়? তুই আমার বিয়ে করা বউ। আমি তোর বিয়ে করা জামম…”
” না, আমি এর আগের কথা বলছি
আমাদের কি আগেও কোথাও…”

তিহিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ওর শরীরে জড়ানো শাড়ীর আঁচল টেনে খুলে ফেলে বলল,
” তোকে এখনই দেখাচ্ছি,আমি কে!”

তিহি কিছু বুঝে উঠার আগেই ওকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল তাজ। দ্রুত পদক্ষেপে গিয়ে দরজা আটকিয়ে এসে ওর উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। ঘটে চলেছে আরেকটি মিলন! যে মিলনে নেই কারোর প্রতি কারো ভালেবাসা!

কল কেটে যাওয়ায় ইশাদ আরেকবার কল দিয়েছে তিহির নাম্বারে। বার বার ওপাশ থেকে ফোন সুইচ অফ বলাতে ইশাদ মানতেই চাইছে না। পাগলের মতো বার বার কল করে যাচ্ছে।

” কি হয়েছে? আপু কল ধরছে না?”

মিহির প্রশ্নে ইশাদের হুশ এসেছে। ফোনটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
” মনে হয় তোমার আপু ফোনে চার্জ দিতে ভুলে গেছে। বার বার বন্ধ দেখাচ্ছে। নতুন সংসার তো তাই এখন একটু-আধটু ভুলে যাওয়া রোগে ভুগবে। চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।”

ইশাদ মিহিকে নিয়ে গাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে মিহি করুণ স্বরে বলল,
” আপনার মতো ঐ ভাইয়াটাকেও আপু ভালোবাসতে পারবে তো?”

ইশাদ পা ফেলা বন্ধ করে মিহির দিকে তাকিয়ে আছে। এমন বাচ্চা মেয়েটার মাথায় এতো কঠিন প্রশ্ন কি করে আসতে পারে?

ইশাদ মিহির নাক টিপে বলল,
” তোমার আপু আমাকে কথা দিয়েছে। আমার থেকেও বেশি ভালোবাসবে তার বরকে। বুঝেছো পাকনি? আর তুমি এতো পাকনি কথা শিখলে কিভাবে?”
” শিখতে হবে কেন? আমি তো সব জানি। আমি কি এখনও বাচ্চা?”

ইশাদ একটা ভ্রূ উঁচু করে বলল,
” তাহলে?”
“আমি এখন অনেক বড়। আপনি জানেন আমি তো আজকেও একটা লাভ লেটার পেয়েছি।”
” তাই নাকি? কই দেখি তো!”

মিহি কপাল কুঁচকে বলল,
” আমার লাভ লেটার আপনাকে কেন দেখাব? এগুলো সিকরেট!”
” আমাকেও দেখানো যাবে না?”
” না।”

মিহির একটা হাত ধরে জোরে জোরে হাঁটা ধরে বলল,
” বুঝেছি,আমার নাকটা খুব শিঘ্রই কাটতে হবে। নাহলে যে তুমি অন্য ছোট নাকওয়ালার সাথে পালাবে এটা আমি নিশ্চিত।”

মিহিকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে ইশাদ বসতেই মিহি আবার বলল,
” আপনি নাক কেটে আসলেও আমি আপনাকে বিয়ে করবো না!”
” সেকি, কেন?”
” কারণ আপনার মনের সব ভালোবাসা তো আপনি আপুকেই দিয়ে দিছেন। তাহলে আমাকে কি দিবেন? আমার তো বেশি বেশি ভালেবাসা চাই।”

ইশাদ স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়েই উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল,
” আচ্ছা বাবা। তোমাকে বেশি বেশি ভালোবাসবে এমন রাজকুমারের সাথেই বিয়ে দিব। আমাকে বিয়ে করতে হবে না।”
” আপু ঠিকই বলে আপনি আসলেই অনেক সুন্দর করে হাসেন। ইশ! আপনি যে কেন আমার সুন্দর ভাইয়া থেকে দুলাভাই হলেন না!”

মিহির ইশ! কথাটা যেন ইশাদের বুকে গিয়ে বিঁধল। নিচেও নামছে না উপরেও উঠছে না এক কষ্টদায়ক যন্ত্রনা বুকে বসে আছে।

_______
দরজায় প্রচণ্ড বাড়ির শব্দ আর মিসেস শিরিন বেগমের চিল্লাচিল্লিতে তিহিকে ফেলেই তাজ উঠে পড়ল। মেঝেতে পড়ে থাকা শাড়ীটা ওর উপর ফেলে দিয়ে সেই মরিচ মেশানো কণ্ঠে বলল,
” এই বার বুঝছিস আমি কে?”

তাজ শার্টের বোতাম লাগিয়ে দরজা খুলতেই শিরিন বেগম ঠাটিয়ে একটা চড় মেরে বসলেন তাজের বা গালে। চোখে রক্ত এনে কর্কশ কণ্ঠে বললেন,
” পশু হয়ে গেছিস তুই।”

এখন যে শিরিন বেগমের থাপ্পড়টা তার গালে পড়বে এটা যেন জানতো তাজ। সেই রকমই একটা ভাব নিয়ে বাইরের যাওয়ার উদ্দশ্যে পা ফেলল।

শিরিন বেগম দ্রুত কদমে তিহির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
” সরি রে মা। আমার আসতে দেরি হয়ে গেল! তাজ যে আচমকা এমন কাজ করে বসবে আমি বুঝতে পারিনি!”

তিহি মিসেস শিরিন বেগমের দিকে শুকনো ঠোঁটের একটি হাসি উপহার দিয়ে তাকিয়ে বলল,
” এমন করে বলছেন যেন উনি ধর্ষক আর আমি ধর্ষিতা! স্বামী হোন উনি আমার। ভুলতো উনার নয় আমারি! আমি বউ হয়েও উনাকে খুশি করতে পারিনি। যদি পারতাম তাহলে নিশ্চয় উনি এমন জোর জবরদস্তি করতেন না।”

তিহির এমন ঠাণ্ডা কথায় মিসেস শিরিন বেগম হতবাক। যেন এমন কথা সে তিহির কাছ থেকে আশা করেননি।

তিহি ধীরে ধীরে উঠার চেষ্টা করে বলল,
” এমন ভুল আর হবে না, ফুপিমা। আমি উনার ভালো বউ হয়ে দেখাব।”

মিসেস শিরিন বেগমের চোখ ছলছল করছে। যেন এখনি চোখ ছেড়ে গাল বেয়ে পানি পড়বে। তিহির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” তুই অনেক লক্ষীরে মা, আমি দোয়া করি তোর মনের সবটা ভালোবাসা দিয়ে যেন তুই তাজের ভালো বউ হয়ে উঠতে পারিস!”

ভালোবাসা কিভাবে দিবো গো ফুপি? ভালোবাসা তো আমার কাছে নেই। আমি যে সবটা অন্য একজনকে দিয়ে কাঙাল হয়ে এসেছি। তবে ভালোবাসা দিতে না পারলেও দায়িত্ব দিয়ে আমি ঠিক ভালো বউ হয়ে দেখাব। আমি যে একজনকে কথা দিয়েছি। তার জন্য অন্য একজনকে ঠকাব না। তার জন্য অন্য একজনের আশা, ভরসা, স্বপ্ন ভেঙে দিব না। তার জন্য অন্য একজনের সংসার অপূর্ণতা রাখব না। তার জন্য অন্য একজনের ছোঁয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখব না!

তিহি শাড়ীটা পড়ে নিতে নিতে বলল,
” আমার গোসল করা প্রয়োজন। তুমি কি আমাকে একটা শাড়ী দিবে?”

মিসেস শিরিন বেগম আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। শব্দহীন কান্নায় ভেঙে পড়লেও সাথে সাথে চোখের পানি মুছে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

___________
“সন্ধ্য হয়ে গেলো। ইশাদ তো এখনও ফিরল না।”

মিসেস মরিয়ম বেগম চিন্তিত হয়ে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন জমিল সাহেবের দিকে। চায়ের কাপ নিতে নিতেই বললেন,
“চলে আসবে,তুমি চিন্তা করো না।”
“ফোনটাও অফ!”

চায়ে চুমুক দিয়ে উত্তর দিলেন জমিল সাহেব,
” হয়তো চার্জ শেষ!”

মিসেস মরিয়ম বেগম এবার কঠিন স্বরে বললেন,
” তুমি এতো নিশ্চিত হচ্ছো কিভাবে?”

জমিল সাহেব ঠোঁটে হাসি নিয়ে বললেন,
” তোমার ছোট ছেলেটা হুবহু আমার মতো হয়েছে। এবার বলো,আমার নিজের জিনিস,আমি জানব নাতো কে জানবে?”

মিসেস মরিয়ম বেগম দুটো কথা শুনিয়ে দেওয়ার ইচ্ছাপোষণ করতেই ইশাদ হাজির!

__________
রাতের খাবার তৈরি করায় ব্যস্ত শিরিন বেগম। হঠাৎ তিহির উপস্থিতে ধমকে উঠে বললেন,
” এই শরীর নিয়ে তুই রান্নাঘরে কী করছিস? যা রুমে যা।”
” একা একা ভালো লাগছে না,ফুপিমা!”
” তাই বলে রান্নাঘরে চলে আসবি?”
” তুমি যদি রান্নাঘরে থাকো তাহলে তো আমাকে রান্নাঘরেই আসতে হবে।”

শিরিন বেগম ধমকের সুর পাল্টে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললেন,
” আচ্ছা তুই আমার রুমে গিয়ে বস। আমি রান্নাটা শেষ করেই আসছি। রান্না প্রায় শেষ!”

তিহিও হাসির বিপরীতে একটা হাসি উপহার দিয়ে ফুপিমার রুমের দিকে পা বাড়াল।
” তোকে তো বসে থাকতে বলেছিলাম জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

শিরিন বেগমের কণ্ঠ পেয়ে তিহি পেছনে ঘুরতেই আবার বললেন,
” আয়,আমার কাছে এসে বস। তোকে একটু আদর করি!”

তিহি পাশে গিয়ে বসতে ওর চুলে হাত দিয়ে বললেন,
” ভালো বউ হয়ে উঠতে হলে নিজেকেও পরিপাটি করতে হয়,মা। এভাবে অগোছালোভাবে পড়ে থাকলে চলবে?”
” তুমি আমার বিয়েতে আসোনি কেন,ফুপিমা?”

চুলে বিলি কাটা থামিয়ে দিয়ে শিরিন বেগম বললেন,
” জানলে তো আসব।”

তিহি মাথা ঘুরিয়ে ফুপির দিকে ঘুরে বলল,
” মানে? উনি তোমাকে জানায়নি?”
” উহু,তোকে নিয়ে বাসায় আসার একটু আগে আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিল। তোর বর একটা পাগল। সামলাতে পারবি তো?”

মিসেস শিরিন বেগমের প্রশ্ন এড়িয়ে তিহি বলে উঠল,
” এ বাসায় আর কাউকে দেখলাম না যে বাকিরা কোথায়?”
” বাকিরা বলতে?”
” উনার বাবা,মা?”
” বাংলাদেশে তোর বর ছাড়া আর কেউ থাকে না। তোর শ্বশুর শাশুড়ি সব বাইরে থাকে। তাজ যে কেন আমার কাছে পড়ে রয়েছে কে জানে? আমি কত বার করে বলি,ওখানে তোর পুরো ভবিষ্যৎ পড়ে রয়েছে আমার কাছে কেন পড়ে আছিস? উত্তরে কি বলে জানিস?”
” কী?”
” ওর হৃদপিণ্ডকে না নিয়ে ও কোথাও যাবে না।”
” হৃদপিণ্ড?”
” হুম। সেই হৃদপিণ্ড যে তুই। তা তো আমি জানতাম না। এভাবে আমার ছেলেটাকে রেখে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি বল তো? তোর উপর রাগ করে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বাজে বাজে নেশায় ডুবে গিয়েছে। তোকে আবার কিভাবে ফেরত এনেছে আমি জানি না। কিন্তু ওকে আবার স্বাভাবিক করতে হলে তোর যে কঠিন ধৈর্য্য শক্তি ধারণ করত হবে।”

তিহি এবার পুরোপুরি ঘুরে বসেছে। চোখে তার বিস্ময়,
” কী বলছো এসব? আমি তো উনাকে চিনিই না।”
” চিনিস না মানে? তোর আর ওর মধ্যে তো ভালোবাসার সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই।”
” ভালোবাসা?”
” হুম!”

তিহি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। উত্তেজনায় কণ্ঠের স্বর বড় হয়ে এসেছে,
” ফুপিমা,তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? উনার সাথে আমার ভালোবাসা কী করে হতে পারে? আমি তো উনাকে কখনও দেখিইনি। আর যদি ধরেও নিই যে আমি উনার ভালোবাসার মানুষ তাহলে উনি এমন বাজে আচরণ করবে কেন?”
” তুই ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলি তাই হয়তো সে রাগ থেকে…”
” উফ! যেখানে ভালোবাসায় হয়নি সেখানে ছেড়ে যাওয়া আসছে কিভাবে?”
” মানে? তার মানে তুই ওর ভালোবাসা না?”

তিহি ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ে অসহায়ভাবে বলল,
” না!”

তিহির কথায় মিসেস শিরিন বেগম চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ও যদি তাজের ভালোবাসা না হয় তাহলে সে কে? আর ও কে বিয়েই বা করল কেন?
” তুমি এখানে কী করছো?”

তাজের কণ্ঠ পেয়ে দুজনেই ছিটকে উঠে। দুজনেই পলকহীনভাবে তাজের দিকে চেয়ে আছে!

তাজ দরজা ছেড়ে ভেতরে এসে তিহির হাত ধরতে শিরিন বেগম ধমকিয়ে উঠলেন,
” কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস,ওকে?”
“রুমে।”

তাজের হাত থেকে তিহির হাত ছাড়িয়ে বললেন,
” ও আজকে আমার সাথে ঘুমাবে।”
” কেন?”
” আমি বলেছি তাই। যা ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার বাড়ছি।”
” আমার ক্ষিধে নেই।”

তাজ চিৎকার করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে দিল। দরজা লাগানোর শব্দে দুজনে আবার ছিটকে উঠে।

________
শরীর অত্যন্ত দুর্বল হওয়াই তিহির চোখে ঘুম নেমে এলো। নানা চিন্তা,নানা প্রশ্নরা বেশিক্ষণ তিহিকে জাগিয়ে রাখতে পারেনি। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করলেও এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়েছে শিরিন বেগমের পাশে।

ঘুমের ঘোরেও এক প্রকট বিদঘুটে গন্ধ এসে নাকে ঠেকছে তিহির। আসতে আসতে গন্ধটা তীব্রতা রুপ নিতেই চোখ মেলে ফেলে তিহি। পুরো রুম অন্ধকারে ঢাকা। অন্ধকারের মধ্যেও একজোড়া চোখ তার দিকে তীব্রভাবে তাকিয়ে আছে। তিহি চট করে চোখটা বন্ধ করে চিৎকার করে উঠতেই ওর মুখটা চেপে ধরল একটি হাত!

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৬)

তিহি অন্ধকারেও বুঝতে পারছে এমন জঘন্যতম ছোঁয়া কার হতে পারে! নিজের খোলা দুটি হাত দিয়ে তাজকে সরানোর বৃথা চেষ্টা করছে। ফুপিমাকে বড় মুখ করে যতই বলুক না সে ভালো বউ হবে কিন্তু হওয়া কি এতোই সহজ? যার ছোঁয়াতে তিহির পুরো শরীরে ঘৃণাই রি রি করে উঠে,তার মাঝে নিজ ইচ্ছাই কিভাবে নিজেকে সঁপে দিবে? ‘এতো কষ্ট আর এত ঘৃণা আল্লাহ আমাকে কেন দিলো? চোখ বেয়ে ঝরে পড়া প্রত্যেকটা পানির টুকরা আজ অসহায়! চিৎকার করছে একটু শান্তির নিশ্বাস নিতে। যে নিশ্বাসে নেই এই পশুচারি মানুষটার মাতালের গন্ধ!

তিহির ছটফটানিতে তাজের শরীরেও যেন ছটফটানি বয়ে যাচ্ছে৷ তার ছটফটানিরা তেজ দেখিয়ে বলতে চাচ্ছে, ‘দেখি আজ কার ছটফটানির শক্তি বেশি!’

তিহি চাপা স্বরে চিৎকারের মাঝে পাশ ফিরে তাকাল।অন্ধকারে তার পাশে কারো ছায়া নেই। হাত দিয়ে পাশে হাতিয়েও যখন কিছু পেল না তখন বুঝতে পারল তার পাশে ফুপি নেই। ফুপি কোথায় গেলো? আমি তো উনার সাথে ঘুমিয়েছিলাম। তাহলে? উনি কি আমাকে এই পশুটার কাছে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন কিন্তু কেন? উনি তো নিজে আমাকে উনার সাথে ঘুমাতে বলেছিলেন। তাহলে? আমি তো চাইনি উনার সাথে ঘুমাতে। তবুও কেন এমন অবহেলা?

তিহির চোখের পানিগুলো গরমের ফুলকি হয়ে বের হয়ে আসছে।

তাজ তিহির কাছ থেকে সরে এসে লাইট জ্বালাতে তিহি চমকিত। ফুপির রুম থেকে এ রুমে কী করে এলো? তাহলে কি উনি তাকে ঘুমের ঘোরে… না! তিহি আর কিছু ভাবতে পারছে না। শরীরের ব্যথার সাথে মাথার ব্যথাটাও নড়ে চড়ে উঠছে। উফ! এতো কেন ব্যথা হতে হয় তার? দু’দিনেই ক্লান্ত হয়ে আসলে কী করে হবে? তার যে এখনও অনেক ব্যথার মুখোমুখি হতে হবে!

তিহি চোখ, মুখ মুছে তাজের দিকে তাকাল। ঢক-ঢক করে পানি খাচ্ছে সে। এমন একটা ভাব যেন সে এই প্রথম পানি নামক এক অমৃতের স্বাদ নিচ্ছে। যে স্বাদ এতোটাই তীব্র যে এখনই সব খেয়ে না নিলে তার জীবনটাই বৃথা!

অর্ধ ঢাকা শরীরে এই প্রথম তিহি কাউকে দেখছে। ইশাদের সাথে পুরো দেড় বছরের সম্পর্কে থাকলেও কখনও তাকে এভাবে দেখা হয়নি। এক বার সুযোগ ছিলো যে দিনটাই তাকে প্রপোস করেছিল সেদিনও সে এরকম অর্ধ ঢাকা অবস্থাতেই ছিল। তাকে ছুঁয়েও ছিলো কিন্তু তার দিকে তাকানোর মতো সেরকম ইচ্ছেটা হয়ে উঠেনি।

” যার বুকে অন্য কারও জন্য এত ভালোবাসা জমানো সেই বুকটা এমন খোলা রেখে আমার সামনে আসতে আপনার লজ্জা করে না?”

তিহির প্রশ্নে তাজ পানি খাওয়া বন্ধ করে দিল। ঠোঁট গ্লাসে লাগানো অবস্থায় আড়চোখে তিহির দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে চেয়েও না বলেই বাতিটা আবার বন্ধ করে তিহির পাশে শুয়ে পড়ল।

” আপনার নেশা তো এখন অনেকটাই কমে এসেছে। এখন একটু আমাকে ছুঁবেন? আমার আপনার স্পর্শ নিতে ইচ্ছে করছে।”
” কিন্তু আমার করতে ইচ্ছে করছে না। বিরক্ত করিস না, আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমা।”
” আমার ঘুম পাচ্ছে না।”
” তাহলে বেরিয়ে যা!”

তিহি তাজের দিকে কাত হয়ে শুয়ে ওর খোলা পিঠটা হাত দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
” আমার আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে!”

তিহিকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে বলল,
” খবরদার তুই আমাকে ছুঁবি না!”
” কেন? আপনি আমাকে ছুঁতে পারবেন আর আমি আপনাকে ছুঁলেই দোষ?”

তিহির কথাতে তাজ রাগে ফেটে যাচ্ছে। আলো থাকলে তিহি ঠিক দেখতে পারত তাজের মুখে রাগের কতগুলো ভাঁজ পড়েছে!

বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল,
” হ্যাঁ,আমাকে তুই ছুঁবি না। ছুঁবি না মানে ছুঁবি না!”
” একশ বার ছুঁবো। আপনি যেমন আমার স্বামী, আমিও আপনার বউ। আপনি আমাকে ছুঁতে পারলে আমিও আপনাকে ছু…..”

তিহির কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ওর চিবুক চেপে ধরল তাজ। কণ্ঠে বিদ্যুতের ঝটকা নিয়ে বলল,
” মেয়ে মানুষের ছোঁয়া আমি ঘৃণা করি,ঘৃণা! বুঝতে পারছিস তুই? আর এক বার যদি তুই আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করিস,তোকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব!”
” তাহলে আপনি কেন আমাকে ছুঁয়েছেন? আমার বুকেও তো আপনার মতো অন্য একজনের জন্য অসীম ভালোবাসা রয়েছে। সেই বুকে কেন আপনার নখের আঁচড় বসিয়েছেন? কেন? কী করেছি আমি? কী অপরাধ আমার?”

তিহির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাজ উঠে পড়ে। ধপ-ধপ পা ফেলে বেরিয়ে যায় রুম ছেড়ে।

‘আমি জানি আপনি স্বাভাবিক অবস্থায় আমাকে ছুঁতে পারবেন না। কিভাবে ছুঁবেন? আপনি নেশা করে যে পশুরূপ ধারণ করেন, স্বাভাবিক অবস্থায় সেই পশুটা কোথায় খুঁজবেন? এমন পশু হয়ে পাপ কাজ করা আপনার পক্ষে সম্ভব না তাই মদ খেয়ে আমাকে ছুঁতে আসেন। আচ্ছা,মদ খেলে কি আসলেই মানুষ নিজের ইচ্ছাগুলোকে দাফন দিয়ে অন্যায় কাজ করতে পারে? তাহলে আমিও একটু করতাম। আমারও যে খুব ইচ্ছে হয় আমার ইশকে দেওয়া কথা ভুলে গিয়ে একটু অন্যায় করতে!’

___________
মাঝরাতের নিস্তব্ধতাকে সহ্য করতে পারছে না ইশাদ। কেন এতো নিস্তব্ধ সব? কেন আকাশে আজ তারা নেই? কেন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে চাঁদ? তার আকাশের চাঁদ অন্যের বুকে লুকিয়ে গিয়েছে দেখে কি এই অম্বরেরও চাঁদ লুকিয়ে পড়তে হবে? কেন, কেন? আমি যে আজ আমার আকাশের চাঁদ নয় খোলা আকাশের চাঁদ দেখে রাতটা কাটাতে চাই।

ইশাদ কালো মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কোলের মধ্যে ইনা ঘুমিয়ে আছে। ‘এই অবুঝ মেয়েটাকেও আমি কষ্ট দিয়েছি। কী চেয়েছিল আমার কাছে? প্রাইভেট মামনিকেই তো? এই ছোট চাওয়াটাও পূরণ করতে পারলাম না৷ মেয়ের এই ছোট আবদারটাও যদি পূরণ করতে না পারি তাহলে কিসের বাবা হলাম আমি? রাতের আঁধারের সাথে সাথে নিজের ব্যর্থতাগুলোও চেপে ধরছে ইশাদকে। ইনাকে নিয়ে বেলকনি থেকে বেরিয়ে রুমে আসে। বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের নিচে এখনও কালচে নোনা পানির দাগ। মেয়েটা তিহির জন্য কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছিল।

ইশাদ ওর কপালে শুকনো পাপ্পি দিয়ে ভাবছে, ‘তুই তো আমার জন্যও এতো কাদিসনি রে সোনামা। আমার আজ সত্যিই তিহির উপর হিংসে হচ্ছে, খুব হিংসে। এতো অল্প সময়ে তোর মনের ভেতর আমার থেকেও বেশি জায়গা করে নিয়েছে। সোনামা,তুই কাকে বেশি ভালোবাসিস বলতো, আমাকে নাকি তিহিকে?’

ইশাদের মনের প্রশ্ন মনেই রয়ে গেল। ঘুমন্ত ইনা তার ঘুম ভেঙে বলতেও আসেনি সে কাকে ভালোবাসে। যদি ঘুম ভেঙে যেতো তাহলে কার কথা বলতো ইশাদ নাকি তিহি? কাকে বেশি ভালোবাসে ও?

তিহির মতো ঘুমেরাও যে তার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। খুব বুঝতে পারছে ইশাদ। তাই দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। তাকে যে ঘুমাতে হবে,গভীর ঘুম। নাহলে যে প্রত্যেকটা সেকেন্ড তাকে বার বার তিহির কথা মনে করিয়ে দেয়। মনের মধ্যে হাজারও সাজিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো উঁকি দিয়ে তার দিকে চেয়ে বলে, ‘আমরা কী দেষ করেছিলাম যে আমাদের পূর্ণতা দিলে না?’

_________
ঘন্টাখানিক চোখ বন্ধ করে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করা ছাড়া আর তেমন কোনো কাজ করতে পারেনি ঘুমের ট্যাবলেট। ইশাদের ঘুম আসছে না। আসবে কী করে? সে তো তার ঘুমন্তকন্যাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। সাথে তার ঘুমকেও!

ইশাদ জোর করেও নিজের চোখ বন্ধ করে রাখতে পারছে না৷ টানটান করে শুয়ে থেকেও নিজের শরীরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। ইচ্ছে করছে সবকিছুকে মুক্ত করে দিতে সাথে নিজেকেও। ইশাদ শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ল। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিৎকার করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল,

” আমি পারছি না তিহিপাখি। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। তোমাকে ছাড়া সবকিছুকেই আমার কাছে ঠুনকো লাগছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এখনই ঠিক এই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে করছে আর একটা সেকেন্ড, একটা মিনিট, একটা ঘন্টা বেঁচে থাকা মানে আমার তিহিপাখি,আমার আত্মাপাখি,আমার চুষনিকন্যাকে ছাড়া বাঁচা। আমি কিভাবে বাকি জীবন কাটাবো? আমি তো তোমাকে ছাড়া দিনও কল্পনা করিনি, একটা রাতেও স্বপ্ন সাজাইনি! তাহলে কী নিয়ে বাঁচব? কোন আশায় বুকে বাসা বাঁধব? উফ! তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। তোমার কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করছে।তোমার মুখে ইশ! শুনতে ইচ্ছে করছে। তোমার ঘুমন্ত মুখটা যে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে গো আত্মাপাখি।”

ইশাদের কান্না বিজড়িত কথাগুলোতে ইনার ঘুম ভেঙে গেল। ইশাদকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” ও বাবাই,কি হয়েছে তোমার? তুমি কাঁদছো কেন? পঁচা স্বপ্ন দেখেছ? তোমার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে?”

ইনাকে আরো ঝাপটে ধরে ইশাদ বেগহীন কান্নায় ভেঙে পড়ল। এমনভাবে হাউমাউ করে কাঁদছে যেন ইশাদ একটি শিশু আর ইনা তার মা-জননী! যে মায়ের কাছে কিছুক্ষণ কাঁদতে পারলে তার সব কষ্ট মুহূর্তে চলে যাবে।

__________
“রেডি হয়ে নাও। আমরা বেরোব।”

তিহি ঘুম ভেঙে উঠে বসতে তাজের আগমন। খয়েরী পান্জাবীর সাথে সাদা পাজামা পরা। চোখ, মুখে উজ্জ্বল আভায় শ্যামবর্ণটা কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়েছে। দেখলে কেউ বলতেই পারবে না, এ শ্যামবর্ণের পুরুষ।

হাত দিয়ে চুল ঠিক করে পারফিউম লাগাতে লাগাতে তাজ আবার হেঁকে উঠে,
” ঘুম ভাঙার পর বিছানা না ছাড়া হলো আলসেমীর পোক্ত বৈশিষ্ট্য! ”

তিহি আরেকটু সূক্ষ্মভাবে তাজের দিকে তাকালে ও এবার তিহির সামনে এসে দাঁড়াল,
” ইউ হেভ অনলি ২০ মিনিটস। তোমার পাশে পড়ে থাকা এই শাড়ীটাই পরবে।”
” কোথায় যাবো?”
” সেটা তোমাকে না জানলেও চলবে।”

তিহি কিছু বলতে গিয়েও বলার সুযোগ পায়নি তার আগেই তাজ রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেওয়ায় তিহি সেদিকেই তাকিয়ে ভাবছে,
‘হঠাৎ করে কোথায় নিয়ে যাবেন উনি? আর এমন তুই থেকে তুমি করে বলছে কেন? কণ্ঠটাও অন্যরকম লাগছিল। কেমন জানি ঝাঁঝ নেই। তবে রহস্য আছে।’

তিহি ভাবনা-ঘোরে হাতটা কোল থেকে বিছানায় রাখতে হাতে কিছুর ছোঁয়া পেল। দরজা থেকে চোখ সরিয়ে হাতের কাছে নিতেই একটি খয়েরী রঙ মেশানো শাড়ীতে পড়ল।
” সামনে এসে বসো। ”

তিহি তাজের কথামতো শাড়ী পরেছে। চুলটাও আচড়িয়েছে। কিন্তু নেই কোনো মেকাপের ছোঁয়া। এমন সাজে সে এই নিয়ে দুবার সেজেছে।

” কী হলো সামনে এসে বসতে বললাম না?”

তাজের অধিকারী কণ্ঠে তিহি সামান্য ছিটকে উঠেছে। গাড়ির পেছনের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে সামনের দরজার দিকে এগুচ্ছে। চোখ, মুখ এখনও ভাবনালেশ!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here