#নীল_আকাশের_পরী
#এম_আর_এ_আকিব
#পর্ব_২০ (শেষ পর্ব।)
শব্দসংখ্যা: ১৪৯৯
একটু পর দরজা দিয়ে একজন মহিলা প্রবেশ করলো। সম্ভবত আকিবের চাচি। তিনি এসে হাসতে হাসতে বলল, “আমি জানতাম একদিন না একদিন তোরা ঠিক-ই ফিরে আসবি। আর ফিরে এসেই তোরা বদলা নিবি। তাই তোদের সেই সুযোগ না দিতে আমি তখম থেকেই তান্ত্রিককে আমাদের সাথে রেখেছি। তোর সাথে যে একটা পরী আসবে আমি তা জানতাম। কারণ তুই একা এখানে পৌঁছাতে পারবি না। তাই তান্ত্রিক যেন তোর সাথে থাকা পরীকে ব’ন্ধি করে নেয় এজন্যই তাকে সাথে রাখা। আমি জানতাম তোর সাথে থাকা পরীকে ব’ন্ধি করে নিলে তুই দুর্বল হয়ে যাবি। তখন তোকেও ব’ন্ধি করা যাবে।”
কথাগুলো বলে পিশাচের মতো হাসতে লাগলো। অনেকটা বৃদ্ধ হয়েছে কিন্তু খা’রাপ কাজ এখনো করে যাচ্ছে। সে এ কয়দিন পরে মরে যাবে চিন্তা নেই তাই। আকিব হাত দিয়ে তার কা’টা হাত চেপে ধরে রেখেছে যাতে র’ক্ত না বের হয়। কিন্তু তারপরেও ফিনকি দিয়ে র’ক্ত পড়ছে। আকিবের হাতে খুব জ্বলছে। কিন্তু সে তারপরেও বলল, “অট্টহাসি বন্ধ কর। তোদের শায়ে’স্তা করতে আমি চলে এসেছি। এই তর’বারি দিয়েই তোদের বদলা নেবো।”
কথাটি বলে সামনে এগুতে যাবে ঠিক তখন-ই তান্ত্রিক হুংকার দিয়ে বলল, “এখানেই দাঁড়িয়ে থাক বাছা। আর এক পা এগুলে তোর মা আর প্রেমিকাকে চিরজীবনের জন্য আগু’নে পু’ড়িয়ে দেবো। তখন আর চাইলেও তুই তাদের ফিরে পাবি না।”
কথাটি শুনে আকিব খুব ভ’য় পেলো। সত্যিই যদি ওদের পু’ড়িয়ে ফেলে তাহলে তার এখানে আসাটাই তো বৃথা। সে বলল, “তুই এমন কাজ করিস না শয়’তান।”
আকিবের চাচা বলল, “না, সে এ কাজ করবে না। কিন্তু তোকে এই ত’রবারিটা মাটিতে ফেলে দিতে হবে।”
আকিব জানে এই তর’বারি-ই তার একমাত্র অ’স্ত্র। এটি ফেলে দেওয়া মানে তার পরাজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু কী করবে আর? তাদের বাঁচাতে হলে তর’বারি মাটিতে রাখতেই হবে। তাই সে তর’বারিটি মাটিতে রেখে দিলো।”
তর’বারিটি মাটিতে রাখতেই তার চাচা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তারপর তার ছেলেকে বলল, “দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? তাড়াতাড়ি গিয়ে তর’বারিটা তোর দখলে নেয়।”,
বাবার কথামতো সে এসে ত’রবারিতে হাত দিতে যাবে তখন-ই সে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়লো। আবার চেষ্টা করলে আবার দূরে গিয়ে পড়লো। তান্ত্রিক হুংকার দিয়ে বলল, “খবরদার! এই ত’রবারিতে হাত দেবে না। এটা কোনো অশুভ শক্তি হাতে নিতে পারবে না। কেউ যদি তিনবার এটি হাতে নেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে সে মা’রা যাবে।”
কথাটি শুনে সবাই ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু আকিব হাসতে লাগলো। আকিবকে হাসতে দেখে তার চাচার শরীরে যেন আ’গুন জ্বলে ওঠলো। সে তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তরবা’রির প্রয়োজন নেই। ওকে তুই তোর হাত দিয়েই মা’র। ওকে মা’রতে মা’রতে ক্লান্ত করে দেয়।”
বাবার কথা মতো ছেলে আকিবের কাছে এসে আকিবকে মা’রতে লাগলো। ছেলেটির থামার কোনো নাম নেই। সে মা’রছে তো মা’রছেই। আকিব যেন আর সহ্য করতে পারছে না। তার মাথা ঘুরছে। সে মাটিতে বসে পড়লো। কিন্তু এতে সে কান্ত হয়নি। সে আকিবকে আরো বেশি মা’রতে লাগলো। আকিব যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। মাটিতেই শুয়ে পড়লো। আকিবের শরীরে যেন আর একটু শক্তিও অবশিষ্ট নেই। সে অনেকটা বেহুশের মতো শুয়ে আছে। আকিব চোখ মেলা থাকাতে না পারলেও সে সবকিছু শুনতে পাচ্ছে।
আকিবের চাচি বলল, “দেরি করা ঠিক হবে না। বোতল দুটি পু’ড়িয়ে দাও তাড়াতাড়ি।”,
তান্ত্রিক বলল, ” আচ্ছা, আমি এখন-ই পু’ড়িয়ে দিচ্ছি। আ’গুন দাও।”
আকিবের চাচি তান্ত্রিককে আগু’ন দিলেন। আকিব সবকিছু শুনেও যেন বাধা দিতে পারছে না। তার শরীরে যে আর একটুও শক্তি নেই।
তান্ত্রিক আকিবের চাচিকে বলল, “বড়ো একটা চুলা তৈরি করতে হবে।” আকিবের চাচিও তান্ত্রিকের কথামতো ইট দিয়ে চুলার মতো তৈরি করলো। তারপর এখানে কেরোসিন ঢেলে আগু’ন জ্বালানো হলো। সবকিছুই আকিবের সামনে ঘটছে কিন্তু সে কিছুই করতে পারছে না। তান্ত্রিক বোতল দুটি হাতে নিয়ে কী জানি একটা মন্ত্র পড়লো। তারপর সেই বোতল দুটি আগু’নে দিয়ে দিলো। বোতল দুটি আগু’নে দিতেই বিকট শব্দ হলো। হয়তো বোতল ফাঁটার
শব্দ। সেই সাথে আরো দুটি নারী কণ্ঠের চিৎকারও আকিবের কানে এলো। হয়তো নিশি আর আকিবের মায়ের চিৎকার। আকিব নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। চিৎকার করে শুয়া থেকে উঠে বসলো।
চারদিকে শুনশান নীরবতা। কোথায় তান্ত্রিক? কোথায় তার চাচা-চাচি? কোথায় আ’গুন? আকিব চারপাশে তাকাতে লাগলো। সে তো তার ঘরে শুয়ে আছে। পাশের ঘর থেকে দৌড়ে ছুটে এলেন আকিবের আব্বু এবং আম্মু। একটু পর সায়রাও এলো। আকিব চিৎকার করে বলল, “ওরা আমার আম্মু আর নিশিকে মে’রে ফেলেছে। আমি ওদের বাঁচাতে পারলাম না। আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না। আমিও আগু’নে ঝাপ দিয়ে আত্নহ’ত্যা করব।”
আকিবের কথার অর্থ কেউ বুঝতে পারলো না। হঠাৎ আকিব উঠে রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিলো আর বলতে লাগলো আমি ম’রতে চাই। আকিবের আব্বু-আম্মু দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে বেঁধে রাখলেন।
আকিব বসে আছে ডা. প্রশান্ত কুমারের সামনে। তিনি পেশায় একজন ডাক্তার। মানসিক রোগের চিকিৎসা করেন। আকিবও এখন অনেকটা শান্ত হয়ে বসে আছে। আকিবের সাথে তার আব্বু, আম্মু এবং সায়রা ছাড়াও ঐশী বসে আছে। ডা. প্রশান্ত সব ঘটনা শুনে বললেন, “হ্যাঁ, তার সমস্যাটি বুঝতে পেরেছি। আপনারা এটি বলুন সে কি প্রায় সময় একা থাকতো? কম কথা বলতো? তার তেমন ভালো বন্ধু নেই তাই না?”
আকিবের আম্মু বললেন, “হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছেন।”
ডা. প্রশান্ত বললেন, “তার যে সমস্যাটা হয়েছে এটির নাম সিজোফ্রেনিয়া।”
ঐশী বলল, “বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে বললে ভালো হয় স্যার।”
ডা. প্রশান্ত বললেন, “এটি একটি মানসিক রোগ বলা যায়। এ ধরনের রোগীদের মধ্যে বাস্তব চিন্তা একদম কমে যায়। বিভ্রান্ত কিংবা হ্যালুসিনেশন হয়। গায়েবি আওয়াজ শুনতে পায়। যা ঘটেনি বা যা নেই এমন জিনিসও বিশ্বাস করে। এরা কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। এটি মূলত সাইকোটিক ডিজঅর্ডার। এ রোগীরা মানতে চায় না যে তারা কোনো রোগে ভুগছে।
সিজোফ্রেনিয়া রোগীরা দিনদিন একা হয়ে যায়। তারা তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কোনো কারণ ছাড়া হাসে, আবার কারণ ছাড়া-ই কাঁদে। সে নিজেই একটি কল্পনার জগৎ তৈরি করে নেয়৷ সেখানে সে যা ভাবে তা-ই বাস্তব মনে করে।
ঐশী বলল, ” স্যার, এ রোগের বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী?”
ডা. প্রশান্ত বললেন, “এ রোগের ব্যাক্তির চিন্তা-চেতনায় অনেক পরিবর্তন দেখা দেয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
১. পজিটিভ বৈশিষ্ট্য:
এ বৈশিষ্ট্যের নাম পজিটিভ হলেও এটা কিন্তু পজিটিভ নয়। এই পজিটিভ বৈশিষ্ট্যকে আরো ৩ ভাবে ভাগ করা হয়। যথা-
ক. বিভ্রান্তি:
বিভ্রান্তি হলো এমন একটি বিশ্বাস যার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। রোগীর মাঝে অনেক ভ্রান্ত ধারণা থাকে। এই যেমন- রোগী অশরীরীর কথা শুনতে পাচ্ছে কিংবা পরীদের কথা শুনতে পাচ্ছে। তার আপন মানুষ তার ক্ষ’তি করার চেষ্টা করছে। হয়তো আপনদেরকে সে আপন মানতে পারে না। শ*ত্রু ভাবে।
খ. হ্যালুসিনেশন:
হ্যালোসিনেশন তো বুঝেন-ই। যার অস্তিত্ব নেই তা বিশ্বাস করা। তার মনে হবে তার পাশে কেউ আছে। তার শরীরে হাত দিচ্ছে। আবার তার ক্ষ*তি করার চেষ্টা করছে। সব-ই অদৃশ্য কাউকে সে কল্পনা করে। সে ভালোও হতে পারে আবার খা’রাপ।
গ. পেশি অসাড় হয়ে যাওয়া:
রোগী দীর্ঘক্ষণ কোথাও বসে থাকলে তার পেশি অসাড় হয়ে যায়। তাই নড়ার জন্য সে শারীরিক শক্তি হারিয়ে ফেলে।
২. কগনিটিভ বৈশিষ্ট্য:
নির্দিষ্ট কোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারা। কোনো কিছু মনে না থাকা। ধরুন, একটি পড়া মুখস্থ করলে আবার ভুলে যাবে। এরকম।
৩. নেগেটিভ বৈশিষ্ট্য:
রোগীর মধ্যে বেশ কিছু নেগেটিভ বৈশিষ্ট্য থাকে। যথা-
ক. আবেগের উপস্থিত কম থাকা।
খ. পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া।
গ. সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়া।
ঘ. শরীরের যত্ন না নেওয়া।
ঙ. কথাবার্তা কম বলা।
চ. জীবন নিয়ে আগ্রহ না থাকা।
ছ. শক্তি কমে যাওয়া।
এগুলোই একজিন সিজোফ্রেনিয়া রোগীর বৈশিষ্ট্য।”
ঐশী বলল, “কিন্তু বেশ কয়েকটি বিষয় মিললেও সব মিলেনি।”
ডা. প্রশান্ত মিললেন, “সব বৈশিষ্ট্য হয়তো না-ও মিলতে পারে।”
ঐশী বলল, “আচ্ছা, এ রোগটা কেন হয়?”
ডা. প্রশান্ত বললেন, “এ রোগ কেন হয় তা সঠিক করে বলা যায় না। তবে এর বেশি কিছু ফ্যাক্টর আছে। যথা-
ক. বংশগত কারণ:
বাবা-মা যদি এই রোগে আক্রান্ত হোন তাহলে সন্তানের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাবা বা মা যে-কোনো একজন এই রোগে আক্রান্ত হলে সন্তানের হওয়ার সম্ভাবনা ২০% আর দু’জনই এই রোগে আক্রান্ত হলে সন্তানের হওয়ার সম্ভাবনা ৪৫%।
খ. ব্রেইন কেমিস্ট্রি:
মানুষের ব্রেইনে কিছু কেমিক্যাল থাকে। যা এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত থাকে।
গ. পরিবেশগত কারণ:
সিজোফ্রেনিয়া রোগীটা সাধারণ অল্প সময়ে হয় না। শৈশব থেকেই এ রোগের বীজ দানা বাঁধতে থাকে। ছোটবেলার যদি শিশুর ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা হয় তাহলে এ রোগ হতে পারে।”
ঐশী বলল, “এটি কি নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে দেখা দেয়?”
ডা. প্রশান্ত বলল্রন, “এটি নারী-পুরুষ উভয়ের হতে পারে। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে সাধারণত কিশোর বয়সে অথবা ২০-২২ বছর বয়সে এ রোগ দেখা যায়। কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে ২৫-৩৫ বছরের মধ্যে দেখা দেয়।”
ঐশী বলল, “এ রোগের চিকিৎসা?”
ডা. প্রশান্ত বললেন, “বেশ কিছু চিকিৎসা রয়েছে। এখন আপাতত তাকে থেরাপি দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।”
ঐশী বলল, “ধন্যবাদ স্যার।”
ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সবাই চলে আসলো। ঐশীকে সায়রা খবর দিয়েছিল। তারপর ঐশী এসে ডাক্তারকে পরীর সমস্ত ঘটনা বলে।
আকিব আর ঐশী পাশাপাশি হাঁটছে। তার আব্বু, আম্মু এবং সায়রা একটু সামনে হাঁটছে।
আকিব এখন অনেকটা স্বাভাবিক। সে ঐশীকে বলল, “সবকিছুই কি আমার কল্পনা?”
ঐশী বলল, “হুম।”
আকিব বলল, “আমি যে পরীস্থানে দুই রাত ছিলাম তাহলে তখন কোথায় ছিলাম? বাড়িতেও তো ছিলাম না।”
ঐশী বলল, “হয়তো ছিলে কোথাও বনে-জঙ্গলে।”
আকিব বলল, “তাহলে বনে-জঙ্গলে আমি কী খেয়ে বেঁচে থাকলাম?”
ঐশী বলল, “জানি না।”
আকিব তার হাতের দিকে লক্ষ করলো। তারপর ঐশীকে বলল, “হাতের মধ্যে এই কাঁটা দাগ কীসের? আমার হাত তো আমার চাচাতো ভাই কেঁ’টেছিল।”
ঐশী বলল, “সেটাও আমি জানি না। হয়তো নিজে নিজেই কেঁ’টেছ।”
আকিব বলল, “আমি অ’স্ত্র পেলাম কোথায়?”
ঐশী বলল, “এটাও জানি না। আপাতত এটি বাদ দাও। আমার হাত ধরে হাঁটো। ভালো লাগবে।”
আকিব ঐশীর হাত ধরে হাঁটছে আর ভাবছে, “সবকিছু সিজোফ্রেনিয়া বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হতেও তো পারে সবকিছু সত্য।”
আকিবকে অন্যমনস্ক দেখে ঐশী বলল, “সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেয়ো না। চলো হাঁটি।”
তারা দুজন একে অন্যের হাত ধরে হাঁটতে লাগলো।
***সমাপ্ত***