প্রেমমহল,শেষ_পর্ব

0
2827

প্রেমমহল,শেষ_পর্ব
মুমুর্ষিরা_শাহরীন

হাওয়ায় উড়ার ন্যায় কেটে গেলো দিন সাতেক। কাটলো কিছু ভাবনাময় প্রহর। উথাল-পাথাল বুকের অজস্র অনুভূতিরা হলো গাঢ়। বুকের মাঝে দামাল তবলা বাজালো। নিজস্ব অস্তিত্ব জানান দিতেই এলোমেলো হয়ে গেলো বোধবুদ্ধির দলেরা। এমন এক সকালে হৃদয় তোশকাকে ছাদে ডাকলো। তোশকা ভয়ে ভয়ে ছিলো। প্রেয়সী ওকে সব বলেছে৷ এই নিয়ে কিছু দফা রাগারাগি আর ঝামেলাও হয়েছে৷ প্রেয়সী তোশকার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছে, ‘আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তারচেয়েও বড় কথা তোর প্রেমিক আমাকে জঙ্গি বলেছে। আমাকে থাপ্পড় মেরেছে। তারপরেও আমি তোর প্রেমিকের সাথে ঘেষাঁঘেষি করবো ভাবলি কি করে? নিজের রাস্তা নিজে বের কর এবার। আমি আর নাই।’

তোশকার মাথায় দপ করে রাগ’টা জ্বলে উঠলো। হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে? ডাকলে কেনো?’

‘দেখ, আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি না। শুনতেও পছন্দ করি না।’

তোশকার বুক কেঁপে উঠল। হৃদয় আবার বলল, ‘আমি তোকে বিয়ে করতে চাই না, তোশকা।’

যা ভেবেছিলো সেটাই হলো। তোশকার চোখ ভরাট হলো। আতংকিত চোখে চাইলো, ‘কিহ?’

‘কাদিস না। কাদছিস কেনো? পাগল নাকি? শোন, জোর করে কিছু হয় না। তোর প্রতি আমার অনূভুতি গুলো মৃত। আমি কখনো তোকে ভালোবাসা তো দূর বউয়ের মর্যাদাও দিতে পারবো না। একটা রিলেশনশিপে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসটা হলো ফিলিং। অনূভুতি যত গাঢ় ভালোবাসা তত বড়। হয়তো একসময় ভালোবাসারা মরে যায়, কিন্তু অনূভুতি গুলো স্মৃতির পাতায় ঠিকই ঘুরে বেড়ায়। আর সেই অনুভূতিগুলোই ভুলতে দেয় না আমাদের প্রিয় মানুষজনদের। যেমন, দেখ; আমার বাবার তেমন কোনো স্মৃতি কিন্তু আমার মনে পরে না। কারণ কি? কারন, তার প্রতি কখনো কোনোদিন-ই আমার কোনো বাবাময় অনূভুতি সৃষ্টি হয়নি। অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই তো সে দায়িত্ব ছেড়ে পালালো।’

তোশকার চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পরলো। অথচ ও কাদতে চাইছে না। রুদ্ধশ্বাসে সে বলল,

‘এখন কি করতে চাও তুমি? আমাকে বিয়ে করবে না? তাহলে আমার কি হবে? আমাদের বিয়ের ডেট ফাইনাল। সবাইকে ইনভাইট করা শেষ। সব আয়োজনও প্রায় শেষ। এই মুহুর্তে এসে তোমার বলা এই কথাটা আমার জন্য অপমানজনক।’

হৃদয় কঠিন গলায় বলল, ‘গত তিনবছর থেকে তোর সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে। আমি কিন্তু একবারও হ্যাঁ বলিনি। মাঝখানে তোর এই নাটকগুলোর জন্যই হ্যাঁ বলতে বাধ্য হয়েছি। এখন তুই কি চাস আমি আম্মুকে গিয়ে এসব বলি? তুই জোর করে আমাকে বিয়ে করবি?’

তোশকা হতবাক। প্রাণহীন অবাক গলায় ডাকলো, ‘হৃদয় ভাইয়া।’

‘হুম ঠিক, ভাইয়া! এটাই পার্ফেক্ট, বুঝলি?’

হৃদয় চলে যেতে নিলো। তোশকা উচ্চস্বরে বলল, ‘তাহলে আমার কি হবে? আমাকে কে বিয়ে করবে? বিয়ে ভাঙা একটা মেয়ের সমাজে টিকে থাকা কতটা লজ্জাকর তা তুমি পুরুষ কি করে জানবে?’

হৃদয় থামলো। খেয়াল করলো ছাদের এক কোণায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে তাদেরই কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে সোহান। চোয়াল শক্ত করে হৃদয় তোশকাকে টেনে সোহানের সামনে দাঁড় করালো। এরপর সোহানের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বলল,

‘ও তোকে খুব বেশি ভালোবাসে। ওর সাথে তুই সুখী হবি। আমার সাথে কক্ষনো না। একটা কথা আছে, তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে নয়, যে তোমাকে ভালোবাসে তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নাও।’

তোশকা নির্বাক হয়ে গেলো। হৃদয় চলে গেলো। খানিকক্ষণ নিরবচ্ছিন্ন নিরবতার পর সোহান মাথা নিচু করে বলল,

‘আমি সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসি তোশকা। বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি এবং বাসবো। তুমি আমায় বিয়ে করো। কথা দিচ্ছি, কখনো তোমার মুখের উপর কথা বলবো না। ঝগড়া করবো না। তোমাকে ঘরের কাজ করিয়ে কষ্ট দিবো না। আমি হেল্প করবো। বাথরুম পরিষ্কার করে দিবো, কাপড় কেঁচে দিবো, তরকারি কুটে দিবো, ঘর ঝাড়ু দিয়ে দিবো। তুমি শুধু রান্না করবে, ঘর পরিষ্কার রাখবে। তোমার হাতের রান্না যদি কখনো বেশি লবণাক্ত কিংবা ঝালময়ও হয় তবুও কোনো অভিযোগ করবো না। কাদিমুখে খাবো। আর..’

তোশকা ভ্রু কুচকে তাকালো। সোহানের কথা শেষ হতে না দিয়েই বলল, ‘তুমি আমাকে তুমি বলে ডাকছো কেনো? আর দাঁতব্রাশ করেছো?’

সাথে সাথে সোহান মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরলো। তোশকা উল্টো পায়ে চলে যেতে নিয়েও আবার ফিরে এসে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘যেই তারিখে হৃদয় ভাইয়া আর আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো, সেই একই তারিখেই তোমার সাথে আমার বিয়ে। তৈরি হয়ে নাও। নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলে। এবার তোমার মরণ অতি নিকটে।’

তোশকা চলে গেলো। তার দেওয়া এই ভয়ংকর হুমকিতে সোহান নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সংকচিত চোখে।

,

বাসা থেকে বের হতেই দেখা গেলো আজও হৃদয় মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। ওইদিনের পর হৃদয়কে আর দেখা যায়নি। সাতদিন পর দেখায় বুকের ভেতরটা কেমন ছলাৎ করে উঠলো প্রেয়সীর। মাথা নিচু করে হেটে যেতেই হৃদয় হাত টেনে ধরলো। প্রেয়সী দু’পা পেছনে এসে বলল,

‘কি হলো এটা?’

‘হাত ধরে টেনে নিয়ে আসা হলো।’

‘কেনো?’

‘ইচ্ছে হলো।’

‘আপনার যা ইচ্ছে হবে আপনি তাই করবেন?’

‘ওরে মা! আপনি তে চলে গেছো? নাইছ ইম্প্রুভমেন্ট। আই এম ইম্প্রেসড।’

‘আপনাকে ইম্প্রেসড করাটা নিশ্চয়ই আমার উদ্দেশ্য নয়।’

‘নয়?’

‘একদম না।’

হৃদয় এগিয়ে প্রেয়সীর কানের কাছে কিছুটা ফিসফিস করে বলল, ‘কিন্তু এবার হবে। আমাকে ইম্প্রেসড করাটাই তোমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে।’

‘মানে?’

‘মানে, তাড়াতাড়ি চলো আমার সাথে।’

‘কোথায়?’

‘কোথায় আবার? তোমার হব হব প্রেমিকের বাড়িতে। মানে, তোমার হব হব শ্বশুড় বাড়িতে।’

‘ফাইজলামি করবেন না।’

‘একবার মাড়ি বের করা হাসিটা দাও না, হাস্য রাক্ষসী।’

‘কেনো বিরক্ত করছেন? চলে যান না।’

‘যাবো তো। তোমাকে নিয়ে যাবো।’

‘আমি কোত্থাও যাবো না।’

‘যাবে না?’

‘না।’

‘খবর করে ছাড়বো বলে দিলাম।’

প্রেয়সী পিটপিট করে তাকালো। হৃদয় চোখের সামনে একটা কাগজ ধরে বলল,

‘এই যে এটা দেখছো? তোমার প্রেমচিরকুট। তুমি যদি এখন আমার সাথে না যাও। তাহলে আমি বাড়ি ফিরে সুইসাইড করবো। তোমার নাম লিখে যাবো। লিখবো আমাকে ভালোবাসার জালে ফেলে তুমি ঠকিয়েছো। সব প্রমাণ দিয়ে যাবো। তারপর বুঝবে তুমি। কত ধানে কত চাল!’

প্রেয়সী কিছুক্ষণ আহাম্মক এর মতো তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে দিলো। এগিয়ে গিয়ে হৃদয়ের হাতের ভাঁজে হাত রাখলো। হৃদয়ও মিষ্টি করে হাসলো। বাহুবন্ধনের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে প্রেয়সী মুগ্ধ স্বরে আস্তে করে বলল,

‘কি ফালতু আর বাজে থ্রেট! সুইসাইড করতে হবে না। আমার হাতেই তোমার মরণ নিশ্চিত।’

‘তবে আমি শতবার নয় সহস্রবার নয় লক্ষবার নয়, শত, সহস্র, লক্ষ, কোটিবার মরতে চাই।’

প্রেয়সী মুচকি হেসে শুধালো, ‘তাই?’

‘হুম।’

‘তোশকার কি হবে, তবে?’

‘ও বিয়ে করবে।’

‘বিয়ে করবে মানে? তুমি ওকেও বিয়ে করবে?’

‘আরে নাহ। ওকে তো বিয়ে করবে সোহান। আমি তো বিয়ে করবো তোমাকে।’

‘কিন্তু আমি তো তোমাকে বিয়ে করবো না, বোকা গিদর।’

‘দেখা যাবে, হাস্য রাক্ষসী।’

‘উমহু! আমি তো আগে প্রেম করবো। প্রেমমহল গড়বো। আমাদের গল্পের শুরুটা মনে নেই তোমার? শুরুটাই তো ছিলো, ‘এই বোকা ছেলে শোনো, আমার সাথে প্রেম করবা?’

হৃদয় শব্দ তুলে হাসলো। হাতের ভাঁজে নিজ প্রেয়সীর হাত নিয়েই কদম ফেলল। তুমুল ধ্বনির হাসির ঝংকারে মত্ত হলো সেই রাস্তা, গাছ-গাছালি, ফুল-ফল, পাখি, ধুলো আর ধুলো মাড়িয়ে উড়ে যাওয়া গাড়িগুলো। হৃদয় এই প্রথম খুব নিবিড়, মুগ্ধ প্রণয় চোখে তাকালো প্রেয়সীর দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বিমুগ্ধ গলায় হঠাৎ বলে উঠলো,

“প্রণয়ী তুমি
হৃদয় প্রেয়সী
প্রেমমহলে আমন্ত্রণ জানাই
হাস্য রাক্ষসী
বিছিয়ে দিলো যে, প্রেমজমিনে প্রেম-চাদর
তার নাম দিয়েছিলে তুমি, বোকা গিদর।”

সমাপ্ত❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here