#ভালবাসার_উষ্ণতা
#Special_পর্ব শেষ
পানির ছিটা মুখে পড়ায় ঘুম ভেঙে গেলো অয়নের। পিটপিট করে চোখ মেলে ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো তার। প্রাপ্তি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খুব নিপুন ভাবে চুল মুছছিলো। এক দৃষ্টিতে প্রাপ্তিকেই দেখছিলো অয়ন। পরণে বেগুনি রঙ্গের শাড়ি, বেগুনি রঙটা খুব একটা পছন্দ নয় অয়নের কিন্তু হলদেটে সাদা গায়ের সাথে রঙটি যেন মিশে আছে প্রাপ্তির সাথে। যেন রংটি তার জন্য বানানো। অয়নের কাছে লাগছে একটি স্নিগ্ধ বেগুনি পরী দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, মুখে এখনো পানির কণাগুলো মুক্তের মত লেগে আছে। ঘাড়ের গাঢ় তিলটি ছুঁইয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা অয়নকে পাগল করে দিচ্ছে। ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে প্রাপ্তির পিছনে দাঁড়ায় সে, আলতো ঠোঁটে তিলটি ছুয়ে দিতে কেঁপে উঠে প্রাপ্তি। আজ বিয়ের চার বছর হতে চললো তাদের কিন্তু আজো প্রাপ্তি ততোটাই লাজুক যতোটা চার বছর আগে ছিলো। অয়নের ছোঁয়া আজো তার শিরদাঁড়ায় শীতল পরশ বয়ে দেয়। অয়নের ছোঁয়ায় আগেও যেমন কোনো নোংরামি ছিলো না আজও নেই। শুধু ভালোবাসার উষ্ণতা অনুভব হয় এই স্পর্শে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে থুতনি ঠেকিয়ে বলে অয়ন,
– তুমি কি জানো, তুমি বড্ড নিষ্ঠুর?
– কেনো?
– আমি প্রতিনিয়ত, প্রতি সেকেন্ড নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ি। আমি যে তোমাতে আসক্ত হয়ে গেছি প্রিয়তমা। অথচ দেখো তোমার হুশই নেই, প্রতিদিন আরো বেশি মাতাল করে তুলছো আমায়। এটা কি উচিত?
– তাই বুঝি?
– হুম, তাছাড়া বলছি কি? প্রতি সকালে তোমার মায়াবী মুখটা আমায় পাগল করে দেয় অথচ দেখো তুমি নিষ্ঠুরের মতো আমাকে অফিস পাঠিয়ে দাও।
– প্রতিদিন এক ডায়ালগ না দিলে হয় না?
– প্রতিদিন অফিস না গেলে হয় না?
– আবরার ভাই, আব্রাহাম আর বউমনিকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছে। এর মধ্যে তুমিও যদি অফিস না যাও কিভাবে চলবে?
– ভাই আছে মজায়, সুন্দর বউ, বাচ্চা নিয়ে সেকেন্ড হানিমুনে চলে গেলো এখানে আমি প্রথম হানিমুনেই যেতে পারলাম না।
– কোথায়? কোয়াকাটা না ঘুরে আসলাম গতমাসে?
– টু ডেইস থ্রি নাইটস প্যাকেজ আর যাই হোক হানিমুন হয় না। আর ওটা তোমার এক্সিবিশন ছিলো। ওখানে তুমি আমাকে কম নিজের ভক্তদের অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত ছিলে।
– হয়েছে আর পাপি লুক দিতে হবে না। আজ তোমার পছন্দের নাস্তা, ভুনা খিচুড়ি আর চুইঝালের মাংস। রেডি হয়ে যাও নয়তো অফিসের লেট হয়ে যাবে।
– তোমার মুখে তুমিটা একদম বুকে যেয়ে লাগে। আর কত মাতাল করবে মায়াবতী।
– ফ্লার্ট করার স্বভাবটা বদলাবে না তাই?
– আমি আমার আপন বউ এর সাথে ফ্লার্ট করছি ,থুরি না পাশের বাড়ির ভাবির সাথে ফ্লার্ট করতেছি! বলো তো করা স্টার্ট করি?
– খুন করে ফেলবো বলে দিলাম
– অকে, অকে। খিচুড়ি আমি আসছি।
– হাহাহা
– উফফফ মার ঢালা। আর কতবার এই হাসিতে আমার খুন করবে?
বলেই প্রাপ্তির কপালে উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো অয়ন। এই চার বছরে অনেক কিছু বদলিয়ে গেছে, আর্টিস্ট হিসেবে প্রাপ্তি দেশে খুব খ্যাতি পেয়েছে। আবরার এবং অয়নের কোম্পানি টপ টেন কোম্পানিতে চলে এসেছে। রাইসা ও কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসেবে জয়েন করেছে। আব্রাহামের হেলথ এখন অনেক প্রগ্রেসিভ পজিশনে। আরেকটু বড় হলে ছোট একটা অপারেশন করলেই হবে। মহীমা সিকদার মারা গেছেন ২ বছর হয়েছে। তার সব সম্পত্তি আবরার দান করে দিয়েছে। প্রাপ্তি আর অয়নের সংসারে কোনো কমতি নেই সুখের, কমতি আছে শুধু একজন নতুন সদস্যের কিন্তু প্রাপ্তির পক্ষে বাচ্চা নেওয়াটা একটু রিস্কি হয়ে যাবে বলে অয়ন বাচ্চা নিতে নারাজ। বারবার বুঝিয়েও টায়ার্ড প্রাপ্তি। কিছুতেই বাচ্চা নিতে রাজী নয় সে। দরকার হলে দত্তক নিতেও রাজী অয়ন। কিন্তু প্রাপ্তির জীবন নিয়ে রিস্ক নিবে না সে। মাঝে মাঝে যখন আড়ালে প্রাপ্তি কাঁদে তখন নিজেকে সামলানোও কঠিন হয়ে পড়ে অয়নের ক্ষেত্রে, কিন্তু সে প্রাপ্তিকে হারাতে রাজী নয়। সেও চায় একটা ছোট প্রাপ্তি তাদের টুনাটুনির দুনিয়াতে আসুক, যাকে দেখে সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষেই ঘুচে যাবে। যাকে কোলে নিলে মনের থাকা খালি জায়গাটা পূরণ হয়ে যাবে। যার আধো আধো বুলিতে বলা বাবা ডাক হবে পৃথিবীর সবথেকে মিষ্টি বুলি। কিন্তু এর বিনিময়ে প্রাপ্তিকে হারাতে সে রাজী নয়। সুখেই তো আছে, না হয় থাক কিছু অপূর্ণতা, কি যায় আসে।
রাত ৮টা,
অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসেছে অয়ন। সারাদিন প্রাপ্তির সাথে কথাও হয় নি। বাড়িতে এসেই দেখলো কোন কাজের লোক নেই। বেশ খটকা লাগলো অয়নের। নিজের রুমে পা রাখতেই দেখলো সারা ঘর অন্ধকার। প্রাপ্তিকে ডাক লাগালো সে, কিন্তু কোনো সারা না পেয়ে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। হঠাৎ খেয়াল করলো কোনো মানবী ধীরে ধীরে ঘরের সকল মোম জ্বালাচ্ছে। নুপুরের ঝংকারে মুখরিত ঘর। সারাঘর মোমের আলোয় আলোকিত, গোলাপের সৌরভে মুখরিত। আর সামনের মানবীর দিক থেকে যেন চোখ ই সরছে না অয়নের। সাদা শাড়িতে কোনো স্বর্গের অপ্সরা থেকে কম লাগছে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অয়ন তার মায়াবতীর দিকে। হাতের ব্যাগটা বেডের পাশে রেখে হাতের বাঁধন দিয়ে গলাটা জড়িয়ে ধরে প্রাপ্তি ধীর গলায় বললো,
– আজ জ্যোৎস্না বিলাসের শখ জেগেছে? অয়ন সিকদারের স্ত্রী আজ জ্যোৎস্না বিলাস করতে চায়। খাওয়া দাওয়ার পর ছাদে যাওয়া যাক?
– আজকে ম্যামের মতলব তো সুবিধার মনে হচ্ছে না, ব্যাপারটা কি?
– আজকের ডেট কি স্যারের মনে আছে?
– আগষ্টের ৩ কেনো?
– তোমার মনে নেই?
– কেনো মনে থাকবে না, আজ প্রথম আমি তোমায় আমার মনের কথা বলেছিলাম।
– তাহলে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে যান, খেয়ে ছাদে যাবো। আজ পূর্ণিমা।
– বেশ যো হুকুম মহারানী।
বলেই কাবার্ডের কাছে চলে যায় অয়ন। কাপড় নিতে নিতে একটা ফাইল চোখে পড়ে, ফাইলটি খুলতেই যা চোখে পড়ে তাতে মূহুর্তের জন্য মাথা ফাঁকা হয়ে যায় অয়নের। তাহলে এজন্যই এতো প্রস্তুতি।
খাওয়ার পর ছাদের দোলনায় গিয়ে বসে তারা দুজন। আজ প্রাপ্তির মন খুব ভালো, প্রাপ্তিকে এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে অয়ন। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রাপ্তি বলে,
– আজ চাঁদটাকে বড্ড সুন্দর লাগছে তাই না?
– আমার চাঁদ তার থেকেও সুন্দর। আমার চাঁদকে দেখে আকাশের চাঁদও হিংসা করে।
– আজ যদি তোমার কাছে কিছু চাই, দিবে?
– তুমি জানো আমি তোমাকে কি দিতে পারবো না, এ বাদে যা চাইবে সব দিতে রাজি।
– মাতৃত্বের স্বাদ পেতে যে আমার বড্ড ইচ্ছে হয় অয়ন। আমার একটাই আক্ষেপ, আপনার ইচ্ছে হয় না আমাদের একটি সন্তান থাকুক।
– কম ডক্টর তো দেখাই নি প্রাপ্তি, তবুও কেনো?
– আজ আমি অন্য কিছু চাইবো, দিবেন?
– যদি সামর্থ্যে হয় তবে দিবো।
– শমশের আংকেল ফোন করেছিলো। একটা নবজাতক মেয়ে বাচ্চা কে জানে অনাথ আশ্রমের বাহিরে রেখে গেছে। বলছিলাম যদি বাচ্চাটিকে দত্তক নেওয়া যেত। অনাথ হওয়াটা কেমন সেটা আমাদের থেকে ভালো কেউ জানে না। আমি হয়তো জন্মদাত্রী মা হতে পারবো না, কিন্তু মা তো হতে পারবো। আমাদের টুনাটুনির জীবনও পূর্ণতা পাবে সাথে ও ও বাবা-মার সুখ পাবে। মাতৃত্বের স্বাদ তো এভাবেও পেতে পারি তাই না?
বলতে বলতে গলা আটকে আসছিলো প্রাপ্তির। অয়নের ও চোখ চিকচিক করছে। প্রাপ্তির চোখে মুখে অজস্র চুমু একে দিয়ে বলে,
– থ্যাংক উ, প্রাপ্তি। অবশেষে আমরা ও প্যারেন্টস হবো। থ্যাংক উ।
– তুমি রাজি?
– এই দত্তকের ব্যাপারটা অনেকদিন থেকেই আমি বলতে চেয়েছি কিন্তু তুমি মা হওয়ার জন্য এতোটা ডেস্পারেট ছিলে যে বলতে পারি নি।
– থ্যাংক উ।
বলেই প্রাপ্তি অয়নকে জড়িয়ে ধরলো। অয়ন হুট করেই প্রাপ্তিকে কোলে তুলে নিলো।
– আজ আবার নতুন করে তোমায় ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে মায়াবতী, মে আই?
প্রাপ্তি কোনো কথা না বলে অয়নের বুকে মুখ লুকালো। অয়ন রুমের দিকে রওনা দিলো। রুমে এসে বিছানায় বসিয়ে প্রাপ্তির লাজে রাঙা মুখটি দু হাতে আলতো করে ধরলো, চোখজোড়া, গালে, নাকে অজস্র ভালোবাসার ছোঁয়া একে দিলো। প্রাপ্তির পাতলা ঠোঁটজোড়াতে ঠোঁট ডুবিয়ে নিজের অতৃপ্ত হৃদয়কে শান্ত করছে। প্রাপ্তিও অয়নের টি শার্ট খামছে ধরলো। প্রাপ্তি আঁচলে হাত নিয়ে প্রাপ্তি লজ্জায় লাল হয়ে গেলো, বা হাত দিয়ে টেবিল ল্যাম্পটি বন্ধ করে দিলো সে। রাতের গভীরতার সাথে সাথে দুজন মানব মানবীর নিঃশ্বাসের শব্দ গাঢ় হতে লাগলো। কিছু যন্ত্রণা, কিছু ব্যথার মাঝেও দু জন নরনারী তাদের সুখ কুড়াতে ব্যস্ত। আজ দুজন দুজনাতে মিশে একাকার। শেষ রাতের দিকে অয়ন যখন ঘুমে মগ্ন, প্রাপ্তি নিপুন ভাবে তার বরটিকে দেখে যাচ্ছে। মানুষটা একটা নেশার সাগর, দিন দিন যেন তার ভালোবাসায় তলিয়ে যাচ্ছে সে। অয়নের বুকে মাথা রেখে নিবিডভাবে জড়িয়ে ঘুমের সাগরে পা রাখে প্রাপ্তি। ভালোবাসার মানুষগুলো এভাবেই সুখে থাক, ভালোবাসার উষ্ণতা এভাবেই প্রাপ্তি আর অয়নের মনের শীতলতা দূর করুক।।
।।সমাপ্ত।।
মুশফিকা রহমান মৈথি