ভৌতিকপ্রেম,পর্বঃ১,২
Mahfuza_monira
পর্বঃ১
শাঁই শাঁই করে জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকছে। উতলা বাতাসে তোহার অবাধ্য চুলগুলো নড়ে উঠার সাথে সাথে তার মনও দুলে উঠছে। লিমন তোহার কানের কাছে মুখ এনে বলে-
‘চুলগুলোর উপর এত অত্যাচার কেন করছো? ওরা খোলা আকাশে মুক্ত বাতাসে উড়তে চায়। উড়তে দাও ওদের। কেন বেধে রাখছো ওদের?’
তোহা মিষ্টি করে হাসে লিমনের কথা শুনে। লিমন আবারো ফিসফিসিয়ে বলে- ‘হায়েএএএএ… এই হাসিটাই ঘায়েল করে দিলো আমায় একদম।আমার হৃদপিণ্ডের দুয়ারে তোমার মিষ্টি হাসিটা ইয়ায়ায়া বড় একটা হাতুড়ি নিয়ে এসে দ্রিম দ্রিম করে পিটাই। কখন না হৃদপিণ্ড টাই ভেঙে যায়! এরকম অবিচার কি ঠিক বলো?’
লিমনের কথা শুনে তোহা এবার উচ্চশব্দে হেসে উঠে। মিলি তোহার হাসি শুনে আঁড়চোখে তাকায় তার দিকে। সন্দেহের দৃষ্টিতে তোহাকে দেখে বলে-
– তুই ঠিক আছিস? হঠাৎ হাসলি যে এমন করে!
তোহা নড়েচড়ে বসে বলে-
– এমনি একটা মজাদার কথা মনে পড়ে গেলো তাই।
মিলি ঠিক তোহার কথা বিশ্বাস করলো কিনা কে জানে তবে সে আর তোহাকে কোনো প্রশ্ন করলো না। তোহা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। চুলগুলো কে বাধন মুক্ত করতেই তারা আরো অবাধ্য হয়ে পড়ে। এলোমেলো ভাবে উড়তে থাকে এদিক সেদিক। লিমন তোহাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। সে তোহার ঘাড়ে মুখ গুঁজে। ফিসফিস করে বলে –
– কি শ্যাম্পু দিয়েছো? পেনটিন না?
– হু। কি করে বুঝলে!
– না বুঝার কি আছে?
– না কারন ছেলে হয়েও মেয়েদের শ্যাম্পুর ব্যাপারে এত জানো?
– জানতে হয় ডার্লিং জানতে হয়।
– কত মেয়েদের সাথে যে তোমার ইয়ে আছে! কে জানে।
তোহাকে একা একা কথা বলতে দেখে এবার শুধু মিলিই না,রিনিও সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তাদের দৃষ্টি যে তোহার উপর সেটা বুঝতে পেরে তোহা চুপ হয়ে যায়। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে। লিমন কিন্তু থামে না। সে আগের মতই ফিসফিসিয়ে বলে-
– তোমার বান্ধবী গুলা এত ডিটেকটিভ কেন!? একটু প্রেম ও করতে দেয় না আমাদের শান্তি মতন!
তোহা উত্তরে কিছুই বলে না। চুপ করে বসে থাকে।
.
.
একসময় তোহার পিঠে মাথা রেখে লিমন ঘুমিয়ে পড়ে। মাইক্রোর ভেতরের প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তোহারও চোখ লেগে আসছে বারবার। সে নিভু নিভু চোখে লিমনের দিকে তাকায় একবার। লিমনের কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে চুমু খায় আলতো করে৷ তারপর নিজেও পারি জমায় ঘুমের রাজ্যে।
.
.
রোজ রাতে কেউ এসে গোলাপ রেখে যায় তোহার বিছানায়। পাচতলা বেয়ে কে রুমের ভেতর ঢুকে গোলাপ রেখে যাবে?!
আর বাসায় পুরুষ বলতে একমাত্র তোহার বাবা আবরার হক। বাবা নিশ্চয়ই প্রতিদিন মেয়ের বিছানায় গোলাপ রাখবে না!!
এ পর্যন্ত ২২ টি গোলাপ পেয়েছে তোহা কিন্তু কোনোদিনও সেই গোলাপ আশিক কে দেখার সুযোগ হয়নি।
২৩ তম দিনে তোহা মনে মনে ভেবে নেয় যে আজ সে দেখবেই তাকে। কে গোলাপ দিয়ে যায়,তাকে দেখতেই হবে। রাত হতেই ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে বিছানার উপর সে।
সময় প্রবহমান। ১টা গড়িয়ে ২টা বাজতে চললো। কেউ আসেনি এখন অব্দি! আদৌও কি কেউ আসবে!? আসবে হয়তো,এতদিন যখন এসেছে,আজকেও আসবে৷
তোহার চোখের ঘন পাতায় রাজ্যের সব ঘুম হানা দিয়েছে৷ কিন্তু তোহা ঘুমাতে চায় না। নিভু নিভু চোখ নিয়ে কম্বলের ভেতর থেকে চাতক পাখির মত অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে তোহা।
হঠাৎ ডিমলাইটের আলোতে একটা উজ্জ্বল অবয়ব কে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখে তীহা৷ ভয়ে সে চোখ বন্ধ করে নেয়৷ একটা শীতল ঘামের ফোঁটা টুপ করে গড়িয়ে পড়ে তীহার শিরদাঁড়া বেয়ে।
তোহা মনে মনে দোয়া দুরুদ সব পড়া শুরু করে। আজ হার মানলে হবে না। তাকে এই গোলাপ আশিকের মুখোমুখি হতেই হবে তাতে সে ভূত,প্রেত যাই হোক না কেনো।
তোহা আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকায়। অবয়ব টা বিছানায় ফুল রেখে আবার আলমারির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তোহা একটা দম নিয়ে লাফ দিয়ে উঠে হাত ধরে সেই অবয়বের।
একটা শীতল হাত৷ যেন বরফের চেয়েও ঠান্ডা।
অস্ফুট স্বরে তোহা বলে-
– কে!? কে তুমি?
অবয়বটা উল্টো দিকে ঘুরেই বলে -‘ আমি লিমন।’
.
.
হঠাৎ মাইক্রো দুলে উঠলে ঘুম ভেঙে যায় তোহার। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সে। তার আর লিমনের প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্ত টা প্রায় স্বপ্নে হানা দেয় তার চোখে। ধীরে ধীরে কিভাবে যে এই সম্পর্ক টা গড়ে উঠেছিল তোহা নিজেই জানেনা। অথচ সেই সম্পর্কের আজ প্রায় ৭ মাস পূর্ণ হলো।
.
.
.
তোহা ও তার ফ্রেন্ড মিলি, শীষ, বিধান আর তোহার কাজিন রিনি,সবাই রাত ১ টার দিকে মিরপুর থেকে মাইক্রোতে করে রওনা হয় জাফলং এর উদ্দেশ্যে। জাফলং থেকে আরো অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখতে যাবে তারা। নীল আকাশ উপরে,নিচে নীল পানি,সাথে সবুজের সমারোহ! বাহ। ভাবতেই তোহার মন টা রোমাঞ্চকর হয়ে উঠছে বারবার।
.
.
প্রায় সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে সিলেটের বিখ্যাত শাহাজালাল মাজারের সামনে এসে থামে তাদের মাইক্রো টা।
সবাই নেমে পড়ে।
বিধান নেমে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তা দেখে মিলি বলে-
– তোর আবার কি হলো!
– দোস্ত,ব্যাক সাইড শেষ রে বসে থাকতে থাকতে। সোজা করতে পারছিনারে। একটু ধাক্কা দে না।
মিলি ধাক্কা দিতে গেলে তাকে থামিয়ে শীষ বলে-
– আরে দাড়া,একটা ফটো খিচে নেই। ট্রল গ্রুপে পোস্ট করবো। হাহার পর হাহা পড়বে। সেই হবে মাম্মাহ!
বিধান কপট রাগ দেখিয়ে বলে-
– তোর সেই আমি ছুটাচ্ছি দাড়া!
– আগে নিজেকে ঠিক কর,এরপর ছুটাইস!হাহ!
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে শীষ মাজারেএ দিকে এগোতে থাকে। মিলির সাহায্যে সোজা হয়ে দাঁড়ায় বিধান। তারপর তারা সবাই এগিয়ে চলে মাজারের দিকে। যেতে যেতে লিমন তোহাকে বলে -‘তোমার ফ্রেন্ড গুলা এক একটা ড্রানা কুইন! উঁহু কুইন না,কিং।’
তোহা কোনো জবাব দেয়না। সোজা পথ ধরে হাটতে থাকে সে।
.
.
দুইপাশে হরেক ধরনের দোকান,মাঝখানে রাস্তা। রাস্তার মাথায় বিশাল গেট। এটাই শাহাজালাল মাজারে ঢুকার শাহী দরজা।
তোহা মাজারে ঢুকতেই ডান পাশ থেকে কতকগুলো কবুতর উড়ে গেলো। তোহা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। লিমন বলে
– যখন বেঁচে ছিলাম,এখানে এসেছিলাম। তখন শুনেছি যারা মানত করে তারা এই কবুতর দেয় মাজারে। অনেক সুন্দর না?
তোহা আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে
– হু অনেক সুন্দর।
হঠাৎ বিধান চিল্লিয়ে বলে
– গাইস,এদিকে আয় সব। দেখ এখানে কি।
তোহা দৌড়ে চলে সেদিকে। তার খুশি আজ দেখে কে! প্রায় সাড়ে ৮ ঘন্টা জার্নি করে এসেও তার ভেতরে এতটুকু ক্লান্তির ছাপ পড়েনি।
বিধানের কাছে যেতেই সবাই দেখে একটা পুকুর৷ হরেক রকমের মাছ সেখানে। তোহা তার ব্যাগ থেকে পাউরুটি ছিড়ে একটু দেয় পুকুরে ফেলে। ওমনি খপ করে খেয়ে নেয় একটি মাছ৷ তা দেখে তোহা হেসে কুটিকুটি। না জানি,কত মজাদার দৃশ্য দেখছে সে!
দূরে দাঁড়িয়ে লিমন এসব কিছুই দেখছিল মুগ্ধ নয়নে। তোহারা সবাই আশেপাশের সব কিছু উপভোগ করছিল,আর লিমন তোহার চঞ্চলতা কে উপভোগ করছিল।
.
.
মাজার থেকে মাইক্রো তে করেই প্রায় ২০ মিনিট পর জাফলং পৌঁছালো তারা।
মাইক্রো থেকে নেমেই তোহা এক দৌড়৷
রিনি পেছন থেকে তোহাকে উদ্দেশ্য করে বলে-
– আস্তে,উঁচু নিচু বেশ কিন্তু৷ পড়িস না আবার!
কে শোনে কার কথা। তোহা দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই। সাথে লিমন ও। একদম প্রায় পানির কাছাকাছি গিয়ে থামে তোহা আর লিমন। তোহা হাপাতে থাকে। ১ মিনিট সময় পর তোহা তার হাত গুলো বাড়িয়ে দেয়,যেন পুরো প্রকৃতি আজ তার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। লিমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল তোহাকে। তোহা এক চোখ খুলে লিমনের দিকে তাকিয়ে বলে
– তুমিও করো,অনেক ভালো লাগছে এমন করতে। করে দেখো।
লিমন ও তোহার মত হাত গুলো উঁচু তে বাড়িয়ে দেয়৷
তারপর চোখ বন্ধ করে সেও করতে থাকে তোহার মত। আসলেই একটা অন্যরকম প্রশান্তি ঘিরে ধরেছে তাকে।
কিছুক্ষণ পর তোহার কাছে বিধান,মিলি,রিনি, শীষ সবাই চলে আসে।
রিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে-
– জাফলং বাংলাদেশের সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তর্গত, একটি পর্যটনস্থল। এটি সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে, ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। এবং এখানে পাহাড় আর নদীর অপূর্ব মিলন দেখা যায় বলেই এটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিত।
তোহাসহ বাকি সবাই রিনির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কত কিছু জানে! আর কত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতেও পারে!
রিনি তোহার কাজিন হওয়ায়,তোহার ফ্রেন্ড দের সাথে তেমন ফ্রেন্ডশিপ নেই তার। কিন্তু এখন সবাই ভাবছে,এরকম একটা গুগল ফ্রেন্ড সাথে থাকলে মন্দ হয়না।
লিমন তোহার কানে কানে বলে-
– আমার শালী দেখছি সেই টেলেন্টেড গো!
তোহা কিছু না বলে রিনির দিকে এগিয়ে যায়। তার কাধে হাত রেখে বলে-
– এত শিখলি কবে রে!?
– এই একটু আধটু জানি আর কি! এসবের প্রতি ইন্টারেস্ট খুব,তাই সে থেকেই একটু আধটু এসব নিয়ে পড়াশোনা করি!
বিধান এসে রিনির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে-
– ফ্রেন্ড হবা আমাদের?
রিনিও খুশি মনে তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে-
– অবশ্যই৷
মিলিও এসে জয়েন হয় তাদের সাথে। শুধু দাঁড়িয়ে থাকে শীষ। মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকে রিনি কে। বিধান শীষের কাছে গিয়ে তার মাথায় জোরে চাটা মেরে বলে-
– তোমাকে কি ইনভাইটেশন দিতে হবে নতুন করে আমাদের ফ্রেন্ড হওয়ার?
অন্য সময় হলে শীষ বিধান কে এক হাত দেখে নিতো৷ এরা দুজন ফ্রেন্ড হলেও একদম সাপ আর বেজী যেন! একমুহূর্ত ও বুনে থাকে না দুজন।
কিন্তু এখন রিনি থাকায় শীষ কিছু বলে না। রিনির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে
– আমিও তোমার ফ্রেন্ড আজ থেকে।
রিনি ছোট করে হাসে একটু। তাতেই যেন শীষের হৃদপিণ্ডে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হামলা হয়ে যায়।
.
.
সেখানে অনেক মজা করে পানসী হোটেলে দুপুরের খাবার সেড়ে নেয় তারা।
তোহা খাওয়া শেষে হাত ধুতে গেলে সেখানে লিমন বলে-
– একা একাই খেলে! আমাকে একটু সাধলেও না!
– ওহ!? তাই? তুমি বুঝি খুব খেতে সাধলে! ভূতদের খাওয়া লাগেনা। আমি জানি!
– আচ্ছা? খুব চালাক হয়ে গিয়েছো না?
– হু হয়েছি। ভূতের বউ চালাক হবে না আজব!
রিনিও হাত ধুতে এসে বাইরে থেকে তোহার গলা শুনতে পায়। ভেতরে ঢুকতেই তোহা চুপ হয়ে যায়।
তা দেখে রিনি মনে মনে ভাবে-
“তোহা তো একাই! তাহলে কার সাথে কথা বললো ও!”
(চলবে)
ভৌতিকপ্রেম
পর্বঃ২
@Mahfuza_Monira
ওয়াশরুম থেকে তোহা বের হয়ে যেতেই রিনি হাত ধোয়ায় মনোযোগ দেয়। মনে মনে ভাবে,তোহার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতেই হবে। কার সাথে কথা বলে ও,সেটাও জানতে হবে।
রিনি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে সবাই মাইক্রোর কাছাকাছি চলে গেছে। সেও সেদিকে এগোয়। কোথা থেকে শীষ এসে তার সঙ্গ ধরে।
– হাই। কেমন আছো?
মৃদু হাসে রিনি। তাকে হাসতে দেখে শীষ বলে
– হাসছো যে!?
– হাসবো নাইবা কেন? আমরা তো কাল রাত থেকেই একসাথে আছি,তাই হঠাৎ এসে কেমন আছো জিজ্ঞেস করায় হাসি পেলো।
শীষ নিজের বোকামি বুঝতে পেরে মাথা চুলকায়। সে যে লজ্জা পেয়েছে সেটা বুঝতে পারে রিনি। তাই তাকে হালকা করতে বলে
– ইটস ওকে। আমি ভালো আছি। তুমি?
– আমিও ভালো আছি। জাফলং কেমন লাগছে?
– খুবই দারুন। আমি যতটা না কল্পনা করেছিলাম,তার থেকেও বেশি সুন্দর জাফলং। জানো,পাহাড়ি এলাকার মেয়েরা সুন্দর হয় কেন?
– কেন?
– কারন তারা একদম প্রাকৃতিক আলো,বাতাস টা পায়। আর আমরা তো,ধুলোবালিতে জন্মায় আর সেটা খেয়ে খেয়ে বড় হই৷ তাই আমাদের সৌন্দর্য টা কৃত্রিম অনেকটাই। ছোট বেলা থেকেই এই ক্রীম,ঐ ক্রীম,এই ফেসওয়াশ তো ঐ তেল হেনতেন মেখে মেখে বড় হই। আর ওদের তো কিছুই মাখা লাগে না। ওরা এমনিতেই সুন্দর।
শীষ অবাক হয়ে দেখে রিনিকে। রিনি তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে বলে-
– কি হলো?
– দেখছি তোমাকে। তুমি আসলেই একটা মিনি গুগল। কত কিছু জানো!
উত্তরে রিনি কিছুই বলেনা। শুধু মৃদু হাসে একটু।
.
.
শীষ আর রিনিকে দূর থেকেই দেখে যাচ্ছিল বিধান। তারা মাইক্রোর কাছে আসতেই বিধান বলে-
– আপনাদের ইন্ট্রোডাকশন হলে মাইক্রো তে উঠবেন নাকি আপনাদের এখানেই আজীবন এর মত থেকে যাওয়ার ইচ্ছা আছে?
রিনি বিধানের কথা শুনে হেসে মাইক্রো তে উঠে বসে।
তোহা আর মিলি আগে থেকেই ভেতরে ছিল।
বিধান শীষ কে উদ্দেশ্য করে নিচু কণ্ঠে বলে-
– শোন,ঢাকায় গেলে অনেক মেয়ে পাবি। রিনি কে ছেড়ে দে। ওকে আমার অনেক ভালো লাগে।
– তুই ও অনেক মেয়ে পাবি ঢাকায় গেলে। তুই ছেড়ে দে। আমারো ভালো লাগে ওকে।
– শীষ,মেয়েদের সামনে মাইর খাবি, নাকি আমি যেটা বলছি সেটা মানবি,ভেবে নে।
– তুই মাইর খাবি নাকি আমার কথা মানবি সেটা ভেবে নে।
– তোর কথা কী ভাববো! তোর চেহারার কথা ভাবলেই তো বমি চলে আসে।
– আরে যা যা! বমি তো তুই নিজে একটা শালা। এই জন্যেই মেয়েরা তোকে দেখলে তোর উপর বমি করে যায়।বাট আজ পর্যন্ত পটেনি কেউ।
– খুব গভীরে যাচ্ছিস কিন্তু এবার।
– তোর নাকের ভেতর যত গভীর তার থেকে কমই যাচ্ছি।
– শুধরাবি না!
– শুরু টা কে করছিল?
– তুই। তুই ই রিনির সাথে ফ্লার্ট মারছিলি।
– আমি নরমাল হাই হ্যালো করছিলাম। তোর মত আর সবাইকে ভাবিস না,যে শুরুতেই ফ্লার্ট মারবো!
– শীষ তুই কিন্তু…..
বিধান কথা শেষ করার আগেই ভেতর থেকে মিলি চেঁচিয়ে বলে-
– ঐ হারামী দুইটা,ভেতরে আসবি নাকি আমরা চলে যাবো?
বিধান “আসছি” বলে শীষ কে বলে-
– এবারের মত বেঁচে গেলি। কিন্তু পরেরবার পার পাবিনা হুহ।
– দেখে নিবো তোকে,হুহ।
এরপর দুজনেই মাইক্রোর ভেতরে ঢোকে। বিধান সামনে বসে,আর শীষ একদম পেছনে। দুজনের দুদিকে থাকাই ভালো,কথায় কথায় লেগে যায় শুধু।
.
.
জাফলং ইনন রিসোর্টে উঠে তারা।
রুম নেবার সময় তোহা বলে
– আমার এক রুম চাই।
সবাই অবাক হয়৷ মিলি বলে
– কেন? আমরা মেয়েরা একরুম নিবো,ছেলেরা একরুম। তুই একা একরুম নিয়ে কি করবি?
– জানিনা। বাট আমার লাগবে! আর টাকা তো আমার গাইডের সো তুই চিন্তা করিস না। আমার একরুমই চাই।
রিনি যথেষ্ট অবাক হয়। হলো কি মেয়েটার! একা একা সারাদিন বকবক করে! আবার এখন বলছে একরুম চাই!
নাহ,আজকে রাতেই কথা বলতে হবে এই বিষয়ে ওর সাথে।
.
শেষ পর্যন্ত মিলি আর রিনি একরুম,তোহা একরুম আর বিধান,শীষ একরুম নেয়।
.
নিজের রুমে এসে ব্যাগ রাখতেই বিছানায় ঝাপিয়ে পড়ে তোহা। তার পাশে লিমন ও শুয়ে বলে-
– আমার জন্যেই একরুম নিলে তাইনা?
– হুম। নয়তো ওদের সাথে নিলে,তোমার সাথে কথা বলা মুশকিল হয়ে যেত আর তোমার আদর ও খেতে পারতাম না!
লিমন তোহার গাল টেনে বলে-
– দুষ্ট একটা।
– হু।
তোহা ওভাবে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। সারারাত ঘুম হয়নি। এরপর আবার দিনেও হয়নি। সো শরীরের একদম যাচ্ছে তাই অবস্থা।
লিমন ও তোহাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও ঘুমিয়ে নেয়।
.
.
তোহার ঘুম ভাঙে সন্ধ্যায়। উঠে দেখে লিমন নেই। এদিক সেদিক তাকিয়ে কোথাও লিমন কে পায় না তোহা। সে উঠে বসে। কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থাকে। যখনি উঠতে যাবে,তখনি লিমন হুট করে তার সামনে আসে দুকাপ কফি হাতে।
তোহা বিছানায় বসে বলে
– তোমার এই অভ্যাস টা গেলো না! বলেছি না হুট করে আমার সামনে আসবা না! আমার হার্টবিট মিস হয়! শত হোক,আমি তো মানুষ।ভয় বলতে কিছু তো আছে!
লিমন হেসে বলে-
– আচ্ছা,সরি।আর আসবো না। এভাবে।
– হু ওকে। কাপে কি আনছো?
– ওহ! কফি। স্ট্রং কফি। ফর ইউ। ঘুম থেকে উঠলা। এবার একটু কফি খেলে আরো ভালো লাগবে।
– তুমি কি করে যে বুঝো যে আমার কখন কি লাগবে!
– হাবি হু তুমহারা! আমি বুঝবো না তো কে বুঝবে
তোহা বিছানা থেকে উঠে বলে-
– হইছে হইছে। যাও বারান্দায় গিয়ে বসো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
.
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তোহা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেলকনিতে চলে যায়। সেখানে গিয়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
পুরো জাফলং শহর দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। বড় বড় পাহাড়, উঁচু নিচু খাজ,উফফ! কি যে সুন্দর! কাছের পাহাড় গুলো সবুজ দেখতে,আর যত দূরে যাচ্ছে পাহাড় যেন ততই নীল রঙ ধারণ করছে।
লিমন তোহাকে উদ্দেশ্য করে বলে-
– কি? থম মেরে গেলে না? আমিও গিয়েছিলাম যখন এখানে প্রথম এসেছিলাম।
– তুমি এসেছিলে এর আগে?
– হ্যাঁ। আরো ৫ বছর আগে। জীবিত থাকতে।
– ওহ! আর কি কি আছে সুন্দর এখানে?
– অনেক কিছুই। লালাখাল,বিছানাকান্দি,মাধবকুণ্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সেবার সব জায়গায় যেতে পারিনি। শুধু বিছানাকান্দি গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করো ভীষণ সুন্দর দেখতে। ওখানে ধর্ণা আছে। নীল পানির নিচে ছোট বড় অজস্র পাথর। আকাশ টা যেন তার নীল রঙ ঢেলে দিয়েছে একেবারে। তুমি গেলে মুগ্ধতায় হারিয়ে যাবে। কথা বলার মত ভাষা হারিয়ে ফেলবে।
– সত্যি? তবে কালকেই যাবো।
– আচ্ছা যেও। এবার আসো কফি টা খাও। ঠান্ডা হয়ে গেলো!
– হু খাচ্ছি।
লিমন সোফাতে বসে কফি খাচ্ছে। তোহা লিমনের কোলের ভেতর ঢুকে বসে কফির মগ টা হাতে নেয়। আর বেলকনি দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখে সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
হঠাৎ তোহা বলে-
– লিমন একটা কথা বলি?
– বলো।
– তুমি বললে যে জাফলং এসে সব ঘুরতে পারো নি। কিন্তু কেন? কি হয়েছিল?
লিমন একটা দম ফেলে বলে-
– বিছানাকান্দি থেকে আসার পথে আমাদের গাড়িটা এক্সিডেন্ট করে। আমি একদম ব্যাক সিটে ছিলাম।পেছন থেকে একটা বাস এসে লাগিয়ে দিয়েছিল। স্পটেই মারা যাই আমি,তবে বাকিরা ব্যথা পেলেও মারা যায়নি।
তোহা চুপ হয়ে যায়। তার চোখের কোণে পানি জমে উঠেছে। তোহাকে চুপ করে থাকতে দেখে লিমন বলে
– আরে পাগলি! মন খারাপের কি আছে? আমি মরে গেলেও তো আছি এখনো! আছি না? আর সব সময় থাকবো। কারন আমার আর মরে যাওয়ার কোনো টেনশন নেই,ঝামেলা নেই।
তোহা মাথা তুলে বলে
– আর আমি মরে গেলে?
– চুউউউপ। খালি বাজে বাজে কথা। কফি খাও।
– উঁহু বলো না। আমি মরে গেলে? আলাদা হয়ে পড়বো আমরা?
– উঁহু না,তুমি মরে গেলে তুমিও ভূত হয়ে যাবে। এরপর আমরা তাল গাছে উঠে মানুষদের ভয় দেখাবো। হা হা হা।
– তুমি একটা খুব খারাপ। হুহ!
– হু খুব খারাপ আমি। খাও এবার কফিটা।
তোহা আর কিছু না বলে কফি খাওয়া শুরু করে।
হঠাৎ তোহার রুমের দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। তোহা লিমন কে বলে
– তুমি এখানেই থেকো,আমি দেখে আসছি।
তোহা কফির মগটা রেখে উঠে যায়।
দরজা খুলে দেখে রিনি দাঁড়িয়ে।
রিনি ভেতরে ঢুকে বলে
– ঘুমোস নি?
– হ্যাঁ ঘুমিয়েছিলাম। আজান দিবে আরেকটু পরেই। দেখিস না সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। তাই উঠে পড়লাম।
– হুম।
– তুই ঘুমাস নি?
– ঘুমিয়েছি।
– ওহ! হঠাৎ এলি!? কোনো দরকার?
– নাহ,ভাবলাম একা একা বোর হচ্ছিস তুই,তাই দেখতে এলাম।
– না বোর হচ্ছি না। কফি খাচ্ছিলাম। ওহ তোকে একটা জিনিস দেখাবো। এদিক আয়।
তোহা রিনিকে বেলকনিতে টেনে নিয়ে যায়। তারপর বাহিরের প্রাকৃতিক পরিবেশ টা দেখায়। রিনিও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষন। তার থেকেও বেশি অবাক হয়ে যখন আঁড়চোখে দেখে সোফার উপর দুটো কফির কাপ।
রিনি আর কিছু বলে না। তোহাকে বিদায় জানিয়ে চলে আসে। নিজের রুমে এসে ভাবতে থাকে সব কিছু। তোহার একা একা কথা বলা,কফি খাচ্ছিল,তাও মগ দুটো?!
তোহার সাথে কী তাহলে অদৃশ্য কেউ আছে?
(চলবে)