মিথ্যে অভিনয় পর্বঃ ০৪| ভালোবাসার কষ্টের গল্প

0
3719

মিথ্যে অভিনয় পর্বঃ ০৪
লেখকঃ আবির খান

এটা তাহসান কি করলো! মাইরাকে কোলবালিশ ভেবে জড়িয়ে ধরে আছে ও৷ মাইরার যদি এখন ঘুম ভাঙে তাহলে তাহসানের মাথা কাটা যাবে লজ্জায়। যেভাবে হোক মাইরার ঘুম ভাঙার আগেই ওকে বেড ছাড়তে হবে৷ সেই ভেবে তাহসান আস্তে করে মাইরাকে ছাড়তে নিলে মাইরা ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আর ঘুমন্ত কণ্ঠে বলে,

~ আম্মু কোলবালিশটা টানো কেন? আরেকটু ঘুমাতে দেও তো।

বলেই মাইরা তাহসানকে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে। মাইরার কথা শুনে আর কান্ড দেখে তাহসান হেসে দেয়। তবে সেটা নিঃশব্দে, মাইরা শুনতে পায় না। তাহসান হাসতে হাসতে মাইরার দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ মাইরা এখন ওর একদম কাছে৷ স্নিগ্ধ সকালের আভা জানালা ভেদ করে মাইরার মুখের উপর পড়েছে। তাই ওর মুখটা সোনালী হয়ে আছে। একদম বাচ্চা একটা মেয়ে লাগছে ওকে ঘুমন্ত অবস্থায়। মাইরাকে দেখলে তাহসানের মনে অজানা একটা শান্তি অনুভব হয়৷ কিন্তু সেই সাথে তমার দেওয়া কষ্টগুলোরও জানান দেয়। তাহসান এখন কিভাবে নিজেকে ছাড়াবে সেই চিন্তায় আছে৷ তবে ওর কেন জানি অনেক ভালো লাগছে৷ পুরো শরীর জুড়ে নরম স্পর্শে ভরে আছে। তাহসান খুব ভদ্র আর ভালো ছেলে হওয়ায় তমার এতটা কাছাকাছি ও কখনোই হয় নি। একটা গ্যাপ ও সবসময় মেইনটেইন করতো। যেটাই সঠিক। ভালবাসার মানুষটার মনের চেয়ে যদি তার দেহের উপর লোভ কিংবা লালসা থাকে, সেটা ভালবাসা না অন্যকিছু। কিন্তু তাহসান তমার দেহকে ভালবাসে নি, ভালবেসেছিলো ওর মনটাকে। কিন্তু তমা বাসতে পারে নি। তমার কথা ভেবে তাহসানের মনটা খারাপ হচ্ছে আর প্রচুর রাগ উঠছে।

৭.
একটা গরম উষ্ণতা আর পুরুষালি ঘ্রাণ মাইরা অনুভব করতে পারছে। ও আস্তে আস্তে একটু নড়াচড়া করে ওর আশেপাশে কি আছে তা বোঝার চেষ্টা করছে। ও এখনো চোখ খুলে নি৷ ও ভাবছে ও ওর বাসায়৷ তাই চোখ বন্ধ করেই কোলবালিশটাকে সরাতে যেয়ে ওর মন হয়, হঠাৎ কোলবালিশটা এত শক্ত হলো কিভাবে! আর কোলবালিশ এর আবার হার্টবিট আছে নাকি। তাও আবার এত জোরে জোরে৷ মাইরা চোখ বন্ধ করেই হিসাবটা মিলানোর চেষ্টা করছে। ওর হাত যখন তাহসানের চুলের উপর যায় তখন ওর ঘুমটা পুরোপুরি ভাঙে৷ সাথে সাথে ওর মনে পড়ে, গতকাল ও বিয়ে করে নতুন জায়গায় এসেছে। আর সাথে করে কোলবালিশটাও আনে নি। মাইরা মনে মনে বলে,

~ হায় আল্লাহ তাহলে আমি কাকে জড়িয়ে ধরে আছি? হায় হায় আমি যা ভাবছি তা যেন সত্য না হয়৷ প্লিজ প্লিজ।

মাইরা আস্তে করে একটা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ও তাহসানের বুকের মধ্যে। ওকে কোলবালিশ ভেবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। সাথে সাথে লজ্জায় ও চোখ বন্ধ করে ফেলে। পুরো মুখ গোলাপি হয়ে গিয়েছে লজ্জায়। ও মনে মনে আবার বলে,

~ হায় আল্লাহ যা ভয় করেছিলাম তাই হলো। এটা আমি কি করেছি! সব দোষ কোলবালিশটার। ওর জন্য এই বদ অভ্যাস হয়েছে৷ ইসস! উনি এখন কি ভাববে এভাবে আমাকে দেখলে৷ মন হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবো। উফফ।

মাইরা এগুলা ভেবে তাহসানকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে। আরো তাহসানের সাথে মিশে যায়৷ মানে ওর মন বলছে এক কিন্তু শরীর করছে আরেক। মাইরা আবার বলে,

~ আমি এগুলো কি করছি! ওনাকে আরো জড়িয়ে ধরলাম কেন? আমার এরকম লাগছে কেন? আমি কি পাগল হয়ে যাবো? পুরুষ মানুষের স্পর্শ বুঝি এমন হয়? কেন জানি ওনাকে ছাড়তেই মন চাচ্ছে না৷ ইসস! ছিঃ ছিঃ কি বলছি আমি। আমাকে এখনি উঠতে হবে৷ নাহলে উনি জেগে গেলে লজ্জায় আমি নিশ্চিত মারা যাবো।

মাইরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আস্তে আস্তে খুব সাবধানে তাহসানকে ছেড়ে উঠে বসে। নিজেকে দ্রুত ঠিক করে নেয়৷ এরপর তাহসানের দিকে তাকায়। মাইরা ভাবছে তাহসান এখনো ঘুমিয়ে আছে৷ কিছুই টের পাই নি৷ কিন্তু ওদিকে তাহসান যে লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে তা আর মাইরা জানে না৷ কারণ তাহসান মাইরার আগে উঠতে পারে নি। তার আগেই মাইরা উঠে গিয়েছে। মাইরা আস্তে আস্তে তাহসানের একটু কাছে আসে। মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে চেক করে তাহসান ঘুমানো নাকি জাগা৷ ঘুমানো দেখলে মাইরা মন ভরে তাহসানের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর ধীর কণ্ঠে বলে,

~ উফফ! উনি কি কিউট। মন চায় একটা কামড় দিয়া দি নাকের উপর। একটা বজ্জাত ফালতু মেয়ের পাল্লায় পড়ে আমাকে কালকে একটুও আদর করে নি। ইসস! কত কিছু ভেবে বসেছিলাম। বান্ধবীরা এখন যদি কিছু জিজ্ঞেস করে কি যে বলবো। উমম, আদর ওভাবে না করলেও ঘুমের মধ্যে তো আদর পেয়ে গিয়েছি। উফফ! ওনাকে যে কিভাবে জড়িয়ে ধরেছিলাম। (মাইরা লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে)

মাইরা তাহসানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটা লজ্জামাখা মুচকি হাসি দিয়ে আস্তে করে উঠে ওয়াশরুম চলে যায়। মাইরা ওয়াশরুম ঢুকা মাত্রই তাহসান এক লাফে উঠে বসে৷। ও ছিলা মুরগীর মতো ছটফট করছে। মাইরা ওর কত্তো কাছে ছিলো, ওর সম্পর্কে কি কি বললো। নাকে নাকি কামড় দিবে৷ তাহসান ভয়ে হাত দিয়ে ওর নাক ঢাকে। এসব ভেবে তাহসানের অবস্থা খারাপ। বেচারা দ্রুত বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। মাইরার দুষ্টামিতে ওর অবস্থা খারাপ করে দিয়েছে। তবে তাহসানের মুখে ছোট্ট করে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। সেটা তাহসান নিজেও জানে না৷ আর এই হাসির রেখাটা ফুটে ওঠার কারণ একজনই, মাইরার খুনসুটি। কিছুক্ষণ পর মাইরার কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই পিছন থেকে,

~ আপনি! কখন উঠলেন?

মাইরার কণ্ঠ শুনে তাহসান পিছনে ঘুরে তাকায়। ও দেখে মাইরার চোখেমুখে ভিষণ লজ্জা। তাহসানও একটু আগের কথা মনে করে লজ্জা পায় মাইরার দিকে তাকাতে৷ ও আমতা আমতা করে বলে,

– না মানে..ইয়ে একটু আগেই উঠেছি।
~ ওহ।
– হুম। (বাইরে তাকিয়ে)

মাইরা আস্তে করে তাহসানের পিছনে এসে বলে,

~ কফি খাবেন? বানিয়ে নিয়ে আসি?

তাহসান পাশে মাইরার দিকে তাকিয়ে বলে,

– তুমি কফি বানাতে পারো?

মাইরা তাহসানের গায়ে একটা ধাক্কা মেরে রসিক স্বরে বলে,

~ হাহা। আমার হাতের কফি একবার খেলে আপনি বারবার খেতে চাইবেন৷ দাঁড়ান নিয়ে আসছি।

বলেই বাচ্চা মেয়েদের মতো হাসতে হাসতে চলে যায়। তাহসান মাইরার কান্ড দেখে রীতিমতো অবাক। মুচকি হাসছে ও। মেয়েটা মাঝে মাঝে বেখেয়ালি হয়ে যায়। এই লজ্জা পায় তো আবার একদম ফ্রী ভাবে আচরণ করে। তাহসানের ভালোই লাগছে৷ মাইরা কফি আনতে গেলে তাহসান ফ্রেশ হতে চলে যায়। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে ও অবাক হয়ে যায়। ওর মুখে এক চিলতি হাসি দেখা যাচ্ছে। গতকাল অবধি ওর মুখে একটুও হাসি ছিলো না। সব তমা কেড়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু মাইরার আগমনে তাহসানের মুখে আগের মতো সেই হাসিটা পুরোপুরি না আসলেও কিছুটা এসেছে। যা দেখে ও নিজেই অবাক। তাহলে কি মাইরা সত্যিই ওকে ভালো করে দিতে পারবে? তাহসান জানে না৷

৮.
মাইরা হাসিখুশী মুখ নিয়ে কফি বানাতে কি কি লাগে তা ভাবতে ভাবতে কিচেনের দিকে আসে। এদিকে ভাবী আগেই কিচেনে থাকায় তিনি মাইরার হাস্যজ্বল মুখখানা দেখে ফেলেন। তিনি রান্না রেখে মাইরাকে খপ করে ধরেন। মাইরা ভয়ে কেঁপে উঠে। ভাবী খুব খুশী হয়ে বলেন,

~ মাইরা বোন আমার তোমাকে অনেক হাসিখুশী লাগছে। ব্যাপারটা কি বলো তো? তাহসান বুঝি হিহি।

মাইরা ভাবীর কথা শুনে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। পুরো মায়াবী মুখখানা গোলাপি হয়ে গিয়েছে। ভাবী মাইরাকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা খুশী হয়ে বলে,

~ আর বলতে হবে না কিছু। হিহি বুঝে গিয়েছি। তোমার এই লজ্জাসিক্ত মুখখানা আমাকে সব বলে দিয়েছে। জানো আমার অনেক ভালো লাগছে। তোমার ভাইয়া আর আমি যে কত চিন্তায় ছিলাম তা বলার বাইরে। আমরা ভাবছি তাহসান তোমাকে মেনেই নিবে না। কিন্তু তোমাকে হাসিখুশী দেখে অনেক শান্তি লাগছে। শেষমেশ তাহসান এমন কাউকে পেল যে ওকে আবার আগের মতো করে দিতে পারবে। আহ!

মাইরা লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলে,

~ ভাবী আপনি একটু বেশী ভাবছেন। আমাদের মাঝে তেমন কিছু হয়নি। তবে সে আমাকে দূরে ঠেলে দেয় নি। কিংবা কোন খারাপ আচরণ করে নি। আসলে সে অনেক একা ছিলো। মনের মধ্যে অনেক কষ্ট লুকিয়ে ছিলো। হয়তো গতকাল রাতে অনেকটা কষ্ট তার কমেছে। তবে হ্যাঁ আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাকে হাসিখুশী রাখার জন্য সব করবো। তাকে আবার আগের মতো করে ফেলবো।
~ সত্যি বোন পারবে তো? জানো আমাদের বাসার সবাই তাহসানের হাসিখুশী মাখা মুখটা দেখার জন্য বেকুল হয়ে আছে। ছেলেটা এত বড়ো ধাক্কা খেয়েছে যে কাউকে কিছু বুঝতেই দেয় নি। তোমার ভাইয়া আমাকে সব বলেছে। সে অনেকটাই জানে ওর কষ্টটা। ঠিক বলেছো ও খুব একা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন আর কোন চিন্তা নাই। এখন ওর তুমি আছো। আমার বিশ্বাস ও তোমাকেও ভালবেসে ফেলবে ওই ফালতু মেয়েটাকে ভুলে৷ ওই ফালতু মেয়েটাকে ওকে ভুলতেই হবে৷ মেয়েটা ওর সুন্দর জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে। কিভাবে পারে কেউ এমন করতে!
~ ইনশাআল্লাহ ভাবী আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো। উনি আমাকে সব বলেছেন। আমি জানি ওনাকে কিভাবে ভালো করতে হবে৷ আপনাদেরও সাহায্য লাগবে।
~ আমরা সবসময় তোমার পাশে আছি। তা এত খুশী হয়ে কিচেনে আসলে যে?
~ ওহ ওনার জন্য কফি বানাতে হবে৷ অপেক্ষা করছেন উনি।
~ তাই? কফি খাইয়ে মন জয় করা হুম? ভালো ভালো। হিহি।

মাইরা লজ্জা পায়৷ ভাবী ওকে গুতো দিয়ে বলে,

~ আরে লজ্জা নাই। আমাকে তোমার বড়ো বোনের মতো মনে করবে৷ আমাদের জুটিটা বেশ জমবে। কি বলো?
~ জি ভাবী অবশ্যই।
~ আচ্ছা এখন বলো কি কি লাগবে? আমি দিচ্ছি তুমি কফি বানাও৷
~ জি ভাবী বলছি…

মাইরা ভাবীকে নিয়ে নিজ হাতে অনেক সুন্দর করে ভালবাসা মিশিয়ে তাহসানের জন্য এক কাপ কফি বানায়। ভাবী মাইরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,

~ এটা তোমার হাতের প্রথম রান্না এ বাসায়৷ আর সেটা তাহসানই প্রথম খাবে। আশা করি ও অনেক খুশী হবে খেয়ে।
~ থ্যাঙ্কিউ ইউ ভাবী। তাহলে আমি নিয়ে যাই?
~ আচ্ছা যাও। (হাসি দিয়ে)

মাইরা খুব এক্সাইটেড। হাস্যজ্বল মুখখানা আর হাতে কফি নিয়ে তাহসানের কাছে যাচ্ছে। দরজা ঠেলে মাইরা হাসি নিয়ে রুমে ঢুকতেই ‘থ’ হয়ে যায়। ও কল্পনাও করেনি এমন কিছু দেখবে৷ তাহসানও বাকরুদ্ধ হয়ে মাইরার দিকে তাকিয়ে আছে। মাইরা হাত থরথর করে কাঁপছে এ দৃশ্য দেখে। কারণ তাহসান শুধু একটা ট্রাউজার….

চলবে..?

সবার ভালো সাড়া চাই। আর কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু। সাথে থাকবেন সবসময়।

আগের এবং পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্টে দেওয়া হবে৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here