সুখবর্ষণ পর্ব ১

0
860

#সুখবর্ষণ
পর্ব ১
লিখা- Sidratul Muntaz

আজ অষ্টমবারের মতো পাত্রপক্ষ অরিনকে রিজেক্ট করে গেল। চলে যাওয়ার সময় পাত্রের মা মলিনমুখ করে বললেন,” আমরা খুব শীঘ্রই জানাবো।”
অরিন জানে, এই শীঘ্রই সময়টা আর কখনোই আসবে না। অরিনের মা হালিমা হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন,” আর সম্ভব না। মেয়েকে ঘরের খুঁটি বানিয়েই রাখতে হবে।”
অরিনের কান্না পেয়ে গেল অজান্তেই। মা এভাবে কেন বললেন? অরিনের বয়সটাই বা কি? মাত্র বিশে পা রেখেছে। এই বয়সই তো বিয়ের জন্য শেষসীমা নয়। আর যে পাত্র কেবল গায়ের রঙ দেখে পাত্রী রিজেক্ট করে চলে যায় তাদের অরিন মানুষ বলেই মনে করে না।
প্রত্যেকবার পাত্রপক্ষ চলে যাওয়ার পর বাড়িতে শোক দিবস শুরু হয়। মা হতাশ মুখে বসে থাকেন। যেন কেউ মা/রা গেছে। আজও তাই হলো। তবে আজকে নতুন যেটা যোগ হয়েছে, মা একটু পর পর মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে। এতো কিসের কষ্ট তার? অরিন তো মেয়ে হয়েও ছেলের কাজ করে। ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে ছয়টা টিউশন সামলায়। মোট বারো হাজার টাকা ইনকাম হয়। সংসারের সকল দায়িত্ব তার কাঁধে। ছোটবোনদের স্কুলের বেতন দিতে হয়। মাসে মাসে মানুষের ধারের শোধ দিতে হয়। তাদের সংসারে এমন কোনো মাস নেই যেই মাসে ধার নেওয়া হয়নি। মা কোমরের ব্যথার জন্য কাজ করতে পারে না। আলাদা একজন বুয়া রাখতে হয়। অরিন চেষ্টা করে টিউশনি বাড়াতে। কিন্তু সময় পায় না। বেশি বেতনের টিউশনিও যোগাড় হয় না। তাদের মতো অজপাড়াগাঁয়ে থেকে এর চেয়ে বেশি বেতনের টিউশনি পাবার স্বপ্ন দেখাও পাপ।
আগে অরিনদের অবস্থা এতো খারাপ ছিল না। বাবার মৃ’ত্যু আর ভাইয়ার এক্সিডেন্টের পর জীবনে অন্ধকারের ঢল নামল। মা অনেকদিন কোনো কথা বলতে পারলেন না। বিছানায় পড়ে রইলেন। সুস্থ-সবল, যুবক ছেলে হারানোর শোক সহজে কাটানো যায় না।
অরিন ভার্সিটি যাওয়ার সময় তারিন আর জেরিনকে স্কুলে ড্রপ করে যায়। আজও তাই করল। তারিন-জেরিন ক্লাস টু-এ পড়ে। দু’জন জমজ। অরিনের গায়ের রঙ কালো হলেও এই দুইবোন ফর্সা হয়েছে। অরিন এই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে যে, ওদের বিয়ে দিতে মায়ের কোনো অসুবিধা হবে না।স্কুলের গলি পার হওয়ার সময় চায়ের দোকান থেকে হাসাদ ভাই ডাকলেন।
” এইযে অরিন, শুনে যাও।”
অরিনকে অনিচ্ছায় থামতে হলো। হাসাদ ভাই মানুষটা ভালো। কিন্তু ইদানীং তিনি অরিনের দিকে অন্যরকম নজরে তাকাচ্ছেন। রাস্তায় দেখা হলেই অকারণে দাঁড় করিয়ে কথা বলবেন। লাজুক ভঙ্গিতে হাসবেন। অরিনের ভীষণ অস্বস্তি হয়। এই মানুষটিকে সে পছন্দ করে না। কিন্তু এই কথা মুখের উপর বলাও যায় না। মা একবার অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ায় অরিন হাসাদের থেকে ছাব্বিশ হাজার টাকা ধার করেছিল। মাকে হসপিটালে ভর্তি করানো জরুরী ছিল। সেই টাকার শোধ দিতে পারলেই হাসাদ ভাইয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু এতো টাকার শোধ অরিন কোত্থেকে দিবে? তাই যতদিন টাকার ব্যবস্থা না হচ্ছে, হাসাদ ভাইয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
অরিন হাসিমুখে ঘুরে তাকাল,” কি ব্যাপার হাসাদ ভাই?”
” যাচ্ছো কোথায়?”
” এইতো ভার্সিটি যাচ্ছি।”
” ও আচ্ছা, চলো আমি রিকশা ডেকে দেই।”
” রিকশা লাগবে না। আমি হেঁটে যাবো।”
” এতোদূর হেঁটে যাবে? বলো কি! পা ব্যথা করবে তো।”
” প্রতিদিন হেঁটেই যাই। আমার অভ্যাস আছে। তাই সমস্যা হবে না।”
হাসাদ গম্ভীরমুখে কিছু একটা চিন্তা করে বলল,” আমি ভাবছি খুব শীঘ্রই একটা বাইক কিনবো। এরপর তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না৷ রোজ বাইকে করে ভার্সিটি যেতে পারবে।”
অরিনের গা জ্বলে উঠল। কিন্তু সে শুধু হাসল। কোনো জবাব দিতে পারল না। দারিদ্র্যতা মানুষকে মাঝে মাঝে বোবা বানিয়ে দেয়।

ক্যান্টিনে বসে শুকনো রুটি চিনি দিয়ে খাচ্ছিল অরিন। দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে ইলমির এতো মায়া হলো! দু’টো ফ্রাইড রাইস অর্ডার দিয়ে সে অরিনের সাথে বসল। অরিনের হাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে নিজে খেতে লাগল,” দেখি তো কি এনেছিস?”
অরিন আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল,” তেমন স্পেশাল কিছু না। রুটি আর চিনি। সকালে মা অসুস্থ ছিল। তাই রান্না করতে পারেননি। রাতের বেঁচে যাওয়া রুটি নিয়ে আসতে হয়েছে। ”
” খুব মজা।”
ইলমি কত স্বাচ্ছন্দ্যে খাচ্ছে। অরিনের মন ক্রমশ খারাপ হতে লাগল। চূড়ান্ত মনখারাপ হলো যখন দেখল ইলমি তার জন্য ফ্রাইড রাইস অর্ডার করেছে। অরিন সাথে সাথে বলল,” আমার ক্ষিদে নেই।”
” একটা থাপ্পড় দিবো। তোকে ছাড়া একা একা কিছু খেয়েছি কখনও? ”
অরিনের কেঁদে ফেলতে মন চাইল। সবসময় ইলমিই কেন তার জন্য করবে? সে তো ইলমির জন্য আজ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেনি। নিজের বাড়িতে এনে ইলমিকে ভালো-মন্দ কিছু খাওয়াতেও পারেনি। প্রথম যেদিন ইলমি তাদের বাড়িতে গেল, মেন্যুতে তখন ছিল কেবল ডাল আর শুটকির ভর্তা। ইলমি ঝাল খেতে পারে না। আবার এতোবড় ঘরের মেহমানকে শুধু ডাল খেতে দেওয়া যায় না। অরিন কোনমতে একটা ডিমের ব্যবস্থা করল। মাসের শেষ তখন। হাতে কানা-কড়িও নেই। রাসেল ভাইয়ের দোকান থেকে ডিম একটা বাকি আনা হলো। সেই ডিম ইলমি খাওয়ার সময় অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিল তারিন আর জেরিন। কতদিন তারা ডিম খায় না। তারিন রোজই ডিম খাওয়ার বায়না করে। ইলমি নিজের ডিমটুকু তিন ভাগ করে জেরিন আর তারিনকে নিয়ে খেল। অরিনের এইদিক দিয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হয়। ইলমির মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

ইলহান আবার মনে করার চেষ্টা করল। মেয়েটার গায়ের রঙ কালো ছিল। কিন্তু শাড়ির রঙ ছিল সাদা। ধবধবে সাদা। চোখ দু’টি উজ্জ্বল, ঝকঝকে আর গভীর। চেহারায় আত্মবিশ্বাসের ভাব প্রবল। এতো রূপসী একটি মেয়ে অথচ ইলহান তার নামটাই মনে করতে পারছে না। উফ! ইলমি ভার্সিটি থেকে ফেরার সাথে সাথেই ইলহান বোনের ঘরে হানা দিল।
” শোন, সেদিন নাইট পার্টিতে তোর যে বান্ধবী এসেছিল তার নাম কি?”
ইলমি হতাশ গলায় বলল,” ভাইয়া নাইট পার্টিতে আমার মোট আটজন বান্ধবী এসেছিল। তুমি কার নাম জানতে চাইছো?”
” ওইযে, অনেক সুন্দরী। সাদা শাড়ি পরেছিল।”
” সুন্দরী আবার সাদা শাড়ি!” ইলমি ভাবল কিছুক্ষণ। মনে পড়তেই বলে উঠল,” বুঝেছি, মেঘার কথা বলছো নাকি?”
” আমি কিভাবে জানবো? আমি তো তার নাম জানি না।”
” আমাদের ফ্রেন্ডস গ্রুপে তো মেঘাই সবচেয়ে সুন্দরী। আর সেদিন সে সাদা শাড়িও পরে এসেছিল।”
” তাহলে হয়তো মেঘাই।”
” তুমি ওকে কেন খুঁজছো ভাইয়া?”
” সেইরাতে ও আমার একটা উপকার করেছিল। কিন্তু আমি ওকে ধন্যবাদ জানাতে পারিনি। তুই কি ওকে একদিন বাসায় আসতে বলবি?”
ইলমি মুখ টিপে হাসল। মাথা কাত করে বলল,” আচ্ছা বলবো।”
” ঠিকাছে। বলিস কিন্তু মনে করে।”
” মেঘা, মেঘা, মেঘা” নামটা আওড়াতে আওড়াতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল ইলহান। ইলমির কেবল হাসি পাচ্ছে। অবশেষে তার নাক উঁচু রাজপুত্রের মতো দেখতে ভাইটা কোনো মেয়েকে পছন্দ করেছে।

অরিন বাড়ি ফিরেই তাজ্জব বনে গেল। হাসাদ ভাই এসেছে। তারিন আর জেরিনের জন্য চিপস, জুস, কেক, বিস্কিট, আইসক্রিম এনে টেবিল ভরে ফেলেছেন। দু’জন বিছানায় বসে পা দুলিয়ে আরামে খাচ্ছে। মায়ের চেহারা অত্যন্ত হাসি হাসি। অরিন রুমে প্রবেশ করতেই হালিমা আলমারী থেকে শাড়ি বের করে দিয়ে বললেন,” আজ আর টিউশনিতে যাওয়ার দরকার নেই। হাসাদ তোর জন্যই এসেছে। তোকে নিয়ে কোথায় ঘুরতে যাবে। এতোক্ষণ ধরে বসে আছে ছেলেটা। তুই ফোন ধরছিলি না কেন?”
” আমি বাসে ছিলাম মা। আর আমি টিউশনিতে যাবো না কেন? বাচ্চাগুলোর পরীক্ষা। আমাকে যেতেই হবে। এইসময় মিস দিলে গার্ডিয়ান রেগে যায়।”
” এইসব ফকিন্নিদের টিউশনি ছাড়তো। আর করতে হবে না। হাসাদের সাথে তোর বিয়েটা হয়ে গেলেই আমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তখন আমরা সবাই খুব ভালো থাকবো। তোরও পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে টিউশনি করে বেড়াতে হবে না।”
” তুমি এসব কি বলছো মা? আমি কেন উনাকে বিয়ে করবো? উনি একটা অশিক্ষিত, গুণ্ডা।”
হালিমা কটমট করে বললেন,” তোর জন্য কি এখন ডিগ্রীধারী রাজপুত্র আসবে? হাসাদ অশিক্ষিত হলেও অবস্থাসম্পন্ন। এমন ছেলে পাওয়া আর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া একই কথা। তাও নিজে থেকে তোকে পছন্দ করেছে। ঢং করবি না অরিন। হাসাদের সাথে যদি তোর বিয়ে না হয় তাহলে আমার বিষ খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।”
হালিমা শাড়িটা বিছানায় ছুড়ে দিয়ে চলে গেলেন। অরিন সাথে সাথে মুখ চেপে ধরল৷ তার দুইচোখ দিয়ে গড়গড় করে জল পড়ছে। একসময় ভাবল, হাসাদ ভাইয়ের সাথে বিয়েটা হলে মন্দ কি? হয়তো অরিন কোনোদিন সুখী হতে পারবে না। কিন্তু মাথা থেকে ধারের বোঝা নামবে। অরিনের বোন দু’টো একটা নিশ্চিত জীবন পাবে। মা অনেকদিন পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন। অরিন শাড়ি পরে তৈরী হয়ে নিল। আজ সে হাসাদ ভাইয়ের থেকে আরও পাঁচহাজার টাকা ধার চাইবে। ঘর ভাড়া বাকি পড়ে আছে। সামনের মাসে টাকা দিতে না পারলে বাড়ি ছাড়া হতে হবে। টাকার জন্য হলেও হাসাদ ভাইয়ের সাথে ঘুরতে যাওয়াটা দরকার। দারিদ্র্যতা মানুষকে মাঝে মাঝে আত্মসম্মানহীন বানায়।
মেঘা খুশিতে ঝুমঝুম করছে। একবার একে জড়িয়ে ধরছে তো আরেকবার ওকে। অরিন অবাক হয়ে ইলমিকে জিজ্ঞেস করল,” এর আবার কি হলো?”
ইলমি হাসতে হাসতে বলল,” আমার বড়ভাই মেঘাকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছে। ”
” এটা শুনেই এতো খুশি হওয়ার কি আছে?”
” আমিও বুঝতে পারছি না। ওকেই জিজ্ঞেস কর।”
অরিন আর জিজ্ঞেস করতে গেল না। মেঘাকে তার প্রচন্ড অহংকারী মনে হয়। ক্লাসে কখনও অরিনের পাশে মেঘা বসেনি। প্রথমদিন যখন ইলমি অরিনের সাথে মেঘার পরিচয় করিয়ে দিল তখন মেঘা এমনভাবে নাক কুচকিয়েছে যেন অরিন নোংরা জাতীয় কিছু। অরিন অবশ্য মনখারাপ করেনি। এই ধরণের ব্যবহারে সে অভ্যস্ত। কিন্তু মেঘার সাথে অরিন কখনও নিজে থেকে কথা বলে না।
ইলমির ভাইয়ের কথা বেশ ভালো করেই মনে আছে অরিনের। দুইমাস আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেছে। দেখতেও অস্ট্রেলিয়ান হিরোর মতো। গায়ের রঙ এতো ফরসা যে শ্বেত রোগী বলে ভ্রম হয়। অরিন এতো ফরসা ছেলে মানুষ আগে কখনও দেখেনি। তবে মানুষটা একটু পাগলাটে ধরণের। সেদিন রাতে অরিন না ধরলে তো সাত তলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে দিচ্ছিল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here