#The_Magic_Of_Love
#পর্বঃ২,৩
#writer: #মারশিয়া_জাহান_মেঘ
২
স্নিগ্ধ প্রভাতের চিকচিক রোদ এসে পড়েছে প্রাপ্তির চোখে। ছোট ছোট করে চোখ খুলে তাকালো প্রাপ্তি। শুয়া থেকে দুই হাত হাই তুলতে তুলতে বসলো বিছানায়। দেয়াল ঘড়িটার পানে এক পলক তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে বললো, তাড়াতাড়ি উঠতে হবে অনেক বেলা হয়ে গেছে। প্রাপ্তি টাওয়াল নিয়ে সোজা চলে গেলো ওয়াশরুমে।
ফাতেমা বেগম তড়িঘড়ি করে সকালের নাস্তা বানিয়ে ফেলছে। ওনি রান্নাঘরে এসেছে দেখলে প্রাপ্তি রাগের সপ্তম গগনে চলে যাবে তাই প্রাপ্তি আসার আগেই তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে টেবিলে খাবারগুলো সাজিয়ে ফেললেন।
সাদা শার্টের সাথে মেচিং প্যান্ট পড়ে সিঁড়ি দিয়ে হাতের ঘড়ি ঠিক করতে করতে নিচে নামছে রিত্তিক। টেবিলেই বসে আছে হৃদ। হৃদের পাশের চেয়ারে রিত্তিক বসলো। রিত্তিক কে দেখেই হৃদ কানে ফোন নিয়ে এমন ভাবে কথা বলছে যেনো সত্যিই কেউ কল করেছে। হৃদ রিত্তিক কে শুনিয়ে বলতে লাগলো, “হেই রিত্তু..তোমাকে ছাড়া না এইখানে একদম ভাল্লাগেনা। তুমি কি একেবারে বাংলাদেশেই থেকে যাবে? আর আসবেনা? এইসব বলেই হাতের লাল টুকটুকে আপেলটা কামড় দিয়ে আড়চোখে তাকালো রিত্তিক এর দিকে। রিত্তিক থতমত খেয়ে টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকে খেয়ে নিলো। হৃদ ফোনটা টেবিলে রেখে বললো, ইশ দোস্ত পানি আরো লাগবে? লাগলে বল আমি এক বালতি নিয়ে আসি। রিত্তিক রাগী লুক নিয়ে বললো, আমার ফোন ধরেছিলি কেনো? হৃদ ডন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো, আন্টিকে বলবো নাকি? ওলফার কথা। রিত্তিক চেয়ারটা ঘুরিয়ে হৃদের সামনাসামনি মুখ নিয়ে বললো মানে? হৃদ বললো..ওমা এখন ওলফা কে চিনিসনা? হৃদের কথা শুনে রিত্তিক শার্টের কলারটা পিছে নিয়ে কিছুটা ভাব নিয়ে বললো, ওলফা জাস্ট আমার কলেজ ফ্রেন্ড। যদিও আমি বুঝতে পারি যে ওলফা আমাকে লাইক করে বাট আমি ইগনোর করি বুঝলি?
[ হৃদ আর রিত্তিকের কথার মাঝে আয়মান আর মিসেস ইয়াসমিনি চলে এলেন]
আয়মান প্লেটে রুটি নিতে নিতে বললো, হৃদ ভাই তুমি যেনো কি একটা ওলফা না কাকে নিয়ে যেনো কথা বলছিলে? রিত্তিক থতমত খেয়ে যায়। হৃদ আড়চোখে রিত্তিক এর দিকে একটু তাকিয়ে বললো, আয়মান..তোর একবারো মনে হয়না যে তোর একটা ভাবী দরকার? রিত্তিক সবার আড়ালে..হৃদকে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,হৃদ তুই থামবি নাকি… হৃদ যেনো রিত্তিক এর সংকেত বানী বুঝতে পারলো। চুপসে গেলো হৃদ। মিসেস ইয়ামিনি হৃদের কথায় যেনো সুযোগ পেলো ছেলের কানে বিয়ের কথা তুলতে। মিসেস ইয়ামিনি হৃদের উদ্দেশ্যে বললো, ” ঠিকি বলেছো বাবা। আমি একা আর কতো সামলাবো। কথা বলার মতোন একটা মানুষও পায়না যে গল্পজুড়ে বসবো। কি জানি নাতি নাতনির মুখ দেখতে পারবো কিনা [ আড়চোখে রিত্তিকের দিকে তাকিয়ে ]
রিত্তিক বিরক্ত নিয়ে বললো, ওফ মা এই বিষয়ে কথা বলা থামাবে? নাকি আমাকে খেতেই দিবেনা? রিত্তিক হৃদের দিকে একবার চোখ রাঙিয়ে খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়লো। দরজা দিয়ে যাচ্ছে আর বলছে,,আয়মান তাড়াতাড়ি আয় লেইট হয়ে যাচ্ছে।
দুই কোমড়ে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে প্রাপ্তি। ফাতেমা বেগম চুপসে বসে আছে সোফায়। প্রাপ্তি বললো,মা তোমাকে কতোবার না করেছিনা? রান্নাঘরে না যেতে? ফাতেমা বেগম বসা থেকে উঠে প্রাপ্তিকে বললো, তুই ই বল মা..কোনো কাজ না করে কি এইভাবে বসে থাকা যায়? প্রাপ্তি একটু রেগে বলে..আর যেনো নেক্সট টাইমে তোমাকে রান্নাঘরে না দেখি..এইটা বলেই টেবিলে খেতে বসলো।
হৃদ মেঘকে কল দিতেই মেঘ রেগে বললো,”এই তুই তোর কাজিন এর সাথে এতো ইটিশ পিটিশ করিস কেনো? প্রেমের কথা না বললে পেটের ভাত হজম হয়না? হৃদ যেনো এইসব শোনার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো। মেঘের কথা শুনে হৃদ একটা ঢোক গিলে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো, কি হয়েছে তুমি এতো রেগে যাচ্ছো কেনো কিউটিপাই? [ হৃদ মেঘকে আদর করে কিউটিপাই ডাকে ] মেঘ রেগে বললো, কি হয়নি ওইটা বল..তুই সাথির সাথে এতো কথা বলিস কেনো মেসেজে? আহা..কি সুন্দরভাবে তুই সাথিকে বড় বউ ডাকিস বাহ..এইটা বলেই কল কেটে দেয় মেঘ। হৃদ বেচারা অসহায় হয়ে বার বার কল দিতেই কল কেটে দেয় মেঘ।
রিত্তিক অফিস যাওয়ার পথে ফুলের দোকানটায় এক পলক তাকিয়ে দেখলো তার নীল পরীটা নেই। রিত্তিক যেনো মনে মনে পণ করেই ফেলেছে যে এই নীল পরীটাই তার জীবন সঙ্গী। রিত্তিক ড্রাইভ করতে করতে আনমনেই বলে উঠলো..দেৎ, এখন অব্দিতো নামটাই জানা হলোনা..পাশে থাকা আয়মান বললো,ভাইয়া কিছু বললে তুমি? রিত্তিকের যেনো হুঁশ ফিরে..বললো, না না কিছু বলিতো।
আজ ফুলের দোকানে মুটামুটি কমই কাস্টমার তাই প্রাপ্তি চুপচাপ বসে এই শহরের ধূসর চলাফেরা দেখছে। প্রাপ্তি ভাবছে, কি অদ্ভুত পৃথিবী তাইনা! কেউ ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারে নিজেদের জীবিকা অর্জন করছে,আর কেউ সেই ময়লার দূর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য নাকে হাত, রুমাল,মাস্ক ব্যবহার করছে।
এই যে মিস….এক গুচ্ছ সতেজ গোলাপ ফুল হবে? কারো কথায় ধ্যান ভাঙ্গে প্রাপ্তির। সামনে থাকা ছেলেটিকে দেখে মনে মনে বিরক্ত প্রকাশ করলেও মুখে হাসি টেনে বললো,জ্বি আছে। রিত্তিক বললো দিনতো আর পারলে একটু প্যাক করে দিয়েন। প্রাপ্তি কিছু না বলে ভেতরে গেলো..আর গোলাপ গুচ্ছটা আনলো। প্যাক করতে যাবে এমন সময় রিত্তিক একটা নীল খাম দিয়ে বললো,এইটাও ভেতরে রেখে দিন। প্রাপ্তি রিত্তিক এর কথা মতো তাই করলো। অতঃপর রিত্তিককে ফুলের তুড়াটা দিতে গিয়ে প্রাপ্তি লক্ষ করলো রিত্তিক তার দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে চোখে চোখ পড়েছে একে অপরের। প্রাপ্তির তাতে খুব অসস্তি লাগছে। প্রাপ্তি বলছে স্যার টাকাটা! রিত্তিক এর যেনো কোনো হেলদোলই নেই। প্রাপ্তি আরো কয়েকবার বললো,স্যার টাকাটা… তাও রিত্তিক এর কোনো হুঁশ নেই। প্রাপ্তি এইবার বিরক্ত নিয়ে বললো আজব মানুষতো। এইবার রিত্তিজ এর চোখের সামনে হাতে তুড়ি বাজাতেই রিত্তিক এর ধ্যান ভাঙে। রিত্তিক পকেটে হাত দিয়ে বললো,ওহ হে আপনার টাকাটা নিন। রিত্তিক বললো,আচ্ছা একটু পানি হবে? প্রাপ্তি বললো,একটু দাড়ান আমি নিয়ে আসছি। প্রাপ্তি ভেতরে থেকে আসতেই দেখে রিত্তিক নেই। প্রাপ্তি আরো বেশি অবাক হয় এই ভেবে যে গোলাপের তুড়াটা ফেলেই চলে গেছে লোকটা! এখন কি করবে প্রাপ্তি?!.
মতি মিয়া দোকানের সামনে আসতেই দেখে প্রাপ্তি হাতে একটা গোলাপ গুচ্ছ নিয়ে কি যেনো এক মনে ভাবছে। মতি মিয়া বললো,মা এইটা তোমার ফুল? আইচ্ছা এইডা বাসায় লইয়া যাইও…নয়তো আবার ভুলে ফালাই যাইবা। প্রাপ্তি কিছু বলতে যাবে তার আগেই মতি মিয়া বললো, আরে মা টেহা লাগবোনা। দোকানডাতো তোমারই।
রিত্তিক গাড়ি ড্রাইভ করছে আর ভাবছে আচ্ছা নীল পরী কি গোলাপ ফুলটা নিবে? পড়বে কি আমার লিখা মনের চিরকোট? রিত্তিক ভাবনাতে বিভোর।
প্রাপ্তি বাসায় ফিরতেই ফাতেমা বেগম দাঁড় করালেন প্রাপ্তিকে। ফাতেমা বেগম আজ কঠিন হয়ে প্রশ্ন করছেন..এইভাবেই কি তুই সারাজীবন থাকবি প্রাপ্তি? তোর কি মনে হয়না? জীবনের মোড় ঘুড়ানো উচিৎ। প্রাপ্তি ফ্লোড় থেকে মাথাটা তুলে তার মাকে বললো, মা..আমার জীবনের মোড়তো সৃষ্টিকর্তা অনেক আগেই ঘুরিয়ে ফেলেছে আর কি ঘুরানো উচিৎ? এইটা বলেই নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফ্লোরে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রাপ্তি।
রিত্তিক বাসায় ফিরতেই হৃদ তড়িঘড়ি করে বললো,আন্টি এক্টিং শুরু করেন। মিসেস ইয়ামিনি বলতে শুরু করলো..আমার সাথের ভাবীরা দাদি নানি হইয়া গেছে..আর আমি! একটা অভাগার মা..এখনো অব্দি একটা প্রেম পর্যন্ত করতে পারলোনা অকাজের ঢেকি একটা। রিত্তিক এসে বসলো মায়ের পাশে আর বললো, মা তোমার ছেলে এক মাসের মধ্যে প্রেম করবে প্লাস বিয়েও করবে প্রমিস এইটা বলেই চলে যায় রিত্তিক। মিসেস ইয়ামিনি ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন,আমি যা শুনলাম তুই ওকি তা শুনেছিস হৃদ? হৃদ সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে,, মুখে নখ কামড়াতে কামড়াতে বললো হুম তাইতো শুনলাম।
চলবে….
#The_Magic_Of_Love
#পর্বঃ০৩
#Writer:#মারশিয়া_জাহান_মেঘ
আধাঁর যেনো আজ বিষন্নময়। চাঁদ যেনো আজ ধরণীময় না হয়ে তিমিরকারী হয়ে উঠছে। প্রাপ্তি দুই হাত দিয়ে চোখের নোনাজলগুলো বার বার মোছার বৃথা চেষ্টা করছে। যতোবারি অশ্রু মোছনে যাচ্ছে ততোবারি যেনো গাল বেয়ে চোখের কর্ণিশে পানি পড়ছে। শ্যামবর্ন প্রাপ্তির আঁখি জোড়া চোখের পানিতে যেনো রক্তিম রং ধারণ করেছে। প্রাপ্তি বেলকনিতে রাখা ছোট্ট কাঠের খাটের বসনাটায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছে,”যদি চাঁদ ছাড়া তারার সৌন্দর্যই না থাকে..তাহলে একটা আপন মানুষ ছাড়া অপর প্রান্তের মানুষটা কি নিয়ে বাঁচবে?
জীবন যদি ছন্নছাড়া বিষন্নতা ছড়ায় তাহলে জীবনে আলো নামক প্রদ্বীবটা কেনো জ্বলে?
কেনো একটা তরুণী মেয়ের জীবন শুকনো গোলাপের আভেশ ছোঁয়ে যায়?
হৃদঃ তুই ১ মাসের মধ্যে প্রেম করবি মানে কি বলতো? [ ভ্রু কুচকে ]
রিত্তিকঃ তুই কি কানে কম শুনলি নাকিরে হৃদ? নাকি মেঘ কান খারাপ করে দিয়েছে? [ হৃদের দিকে হেসে তাকিয়ে ]
হৃদ মাথার পিছনে দুই হাত রেখে ফ্লোরে দুই পা রেখে বিছানায় শুয়ে মুখ ফুলিয়ে হাফ ছেড়ে বললো, সে আর বলতে? সকালেই কল দিয়েছিলো সাথিকে নিয়ে শুরু করে দিয়েছে ওর রোজকার ঝগড়া। আমি সাথিকে মজা করে বড় বউ ডেকেছি বলে কিউটিপাইয়ের রাগ হয়েছে..এইসব বাদ দে আগে বল..তোর প্রেমের মানেটা কি?
রিত্তিকঃ প্রেম না শুধু বিয়েও করবো।
হৃদ তড়িঘড়ি করে বিছানায় উঠে দুই পা ভাঁজ করে বললো, দোস্ত কোনো মেয়ে মনে ধরেছে নাকি? রিত্তিক এক মনে তাকিয়ে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললো, মেয়ে নয়..হুর পরী। লন্ডনে দেখলাম তো অনেক মেয়ে..তবে ওর মতো না। এই মেয়েটার মাঝে কিছুতো একটা আছেই যার ফলে এই মেয়েটা প্রত্যেকটা মুহূর্তে রিত্তিক খান্নার মনকে আহত করছে। হৃদ এইবার রিত্তিকের চোখের সামনে হাতে তুড়ি বাজিয়ে বললো, মারো তালি,,রিত্তিক খান্না অবশেষে প্রেমে পড়েছে।
ডেড আমি বাংলাদেশে যেতে চায়। একমাত্র আদরের মেয়ের মুখে হঠাৎ বাংলাদেশে যাওয়ার কথা শুনে মিস্টার আফরাদ শেখ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে মেয়ের এক কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট টা মুখ থেকে নিয়ে বললো, ওফ কামঅন মাই ডিয়ার..তুমি ওইসব আউটসাইড Law Classic Country তে কেনো যেতে চাইছো? ঘুরতে চাইলে..অন্যান্য কান্ট্রিতে যাও। ওলফা মুখটা কাঁদো কাঁদো ফেইস করে বললো, নো ডেড আমি বাংলাদেশেই যাবো আর কেনো যাবো তা নিশ্চয় তোমাকে বলতে হবেনা? মিস্টার শেখ এইবার মেয়েকে আদুরে কন্ঠে বললো, মাই ডিয়ার তুমি রিত্তিকের জন্য সারাজীবন বাংলাদেশেই থাকবে? আর তোমার ডেড এর কথা একটু ও ভাববেনা? ওলফা হাতে থাকা আর্থ বৃত্তটা হাতে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বললো, ওফ ডেড..একবার রিত্তিক কে আমার হতে দাও তারপর দেখো কি হয়..না রিত্তিক থাকবে ওই ‘লো’ কান্ট্রিতে আর না আমি…এইটা বলেই ওলফার মুখে ফুটে উঠলো এক বাকা হাসি।
ভাই রিত্তিক তুই কি এতো ভাবছিস বলতো? রিত্তিক একবার হৃদের দিকে তাকিয়ে মুখে হাত মুষ্ঠি করে বলছে, আমার নীল পরীটার অল ডিটেইলস আমাকে জানতে হবে। হৃদ পায়ে তড়ি বাজিয়ে বললো এই ব্যাপার! তুই শুধু নামটা বল মেয়েটার আর কোথায় দেখেছিলি তোর নীল পরীকে? রিত্তিক আমতা আমতা করে বললো, নামটাইতো জানিনা। হৃদ অবাক হয়ে বললো, কি! নাম জানিসনা অথচ ভালোবাসিস? কি প্রেমিকরে তুই। রিত্তিক হৃদের মাথায় একটা আলতো গিট্টু মেরে বললো, জানিনা তো কি হয়েছে জেনেতো আমি নিবোই।
খাবার টেবিলে যেতেই ফাতেমা বেগমের চোখ পড়ে প্রাপ্তির চোখে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। বুঝাই যাচ্ছে কান্না করেছে। ফাতেমা বেগম শান্ত স্বরে ডাকলেন..প্রাপ্তি..
প্রাপ্তি খাবার নাড়ছিলো হাত দিয়ে মাথা নিচু করে। ফাতেমা বেগমের ডাকে মাথা তুলে বললো, হুম মা বলো। ফাতেমা বেগম বললো,ওবাড়িতে কল করেছিলি? প্রাপ্তি বললো, না করিনি তবে কাল একটু ওবাড়িতে যেতে হবে নম্রতার কলেজে একটু দরকার আছে তাই। ফাতেমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, কলেজের বেতন! প্রাপ্তির ছোট্ট জবাব..হুম। ফাতেমা বেগম নিচু কন্ঠে বললেন, আমি সেলাইয়ের কাজটা করলে তোর কষ্ট একটু কম হতোনা? প্রাপ্তি কঠিন কন্ঠে জবাব দিলো, আমি এখনো বেঁচে আছি মা..এইটা বলে খাবারে পানি ডেলে চলে গেলো প্রাপ্তি। ফাতেমা বেগম বারংবার পিছু ডাকলেও সাড়া দেয়নি সে। ফাতেমা বেগম মনে মনে ভাবছেন…মানুষটা মারা যাওয়ার পর একসাথে দুইটা পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে মেয়েটাকে। কখনো নিজেকে নিয়ে একটুও ভাবার সময় পাইনি।
প্রাপ্তি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে৷ বাবা নেই মা আর বোন নিয়েই তার ছোট্ট পৃথিবী। সবে ফুটে উঠা প্রাপ্তিকে দেখে কেউ বুঝার জো নেই যে তার জীবনটা এতোটা বিষন্নময়। তার শ্যামবর্ন মুখের মায়াবী দুই চোখ কিছু কথা বার বার পৃথিবীকে বলার চেষ্টা করতে গিয়েও ব্যর্থ সে।
রিত্তিক খান্না.. বাবা মায়ের বড় সন্তান। ২ ভাই আর এক বোন সাথে আছে তাদের মা যে তাদের ভালো থাকার একমাত্র উৎস। শহরের বেশ নামকরা একজন বিসন্যান্সম্যান রিত্তিক খান্না। যার জন্য হাজার হাজার মেয়ে পাগল কিন্তু সে কখনো এইসব নিয়ে ভাবেনি তবে তার এই না ভাবার জীবনে খুব করে একজন জায়গা করে নিয়েছে সে হলো তার নীলপরী।
আজ আয়মানের কলেজে নামতে হবে রিত্তিককে। আজ শুধু রিত্তিক নয় হৃদও যাবে। সকালের ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়লো তারা। আয়মান বললো হৃদ ভাই..তোমার কোনো জি এফ নাই? হৃদ অসহায় ভাব নিয়ে বললো, কি আর বলবোরে বোন..একটাও জি এফ নাই। বেষ্ট ফ্রেন্ড এর প্যারাই নিতে পারিনা আবার গার্লফ্রেন্ড! সবাইতো আর রিত্তিক খান্না নয়। রিত্তিক চোখ রাঙিয়ে তাকালো। হৃদ চুপ হয়ে গেছে। আয়মান মুখ টিপে হাসছে।
নম্রতা এতোদিন পর বোনকে কাছে পেয়ে কান্নায় জড়িয়ে ধরেছে। নম্রতার সব বান্ধবীগুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নম্রতার দিকে৷ নম্রতা খুব শান্ত মেয়ে। দুধে আলতা তার গায়ের রং। নম্রতাকে আজ অব্দি কেউ প্রয়োজন ছাড়া কখনো কথা পর্যন্ত বলতে দেখেনি। কিন্তু আজ মেয়েটাকে কান্না করতে দেখা! সত্যিই ভাবা যায়না। প্রাপ্তি নম্রতাকে বার বার বলছে কাঁদিসনা বোন। কিন্তু কে শুনে কার কথা? অনেকদিন পর কাছে পাওয়াতে হয়তো কান্না আটকে রাখতে পারছেনা সে। প্রাপ্তি মজা করে বললো, কান্না কর তবে নাকের পানি ফেলিসনা যেনো আমার জামায়। নম্রতা কান্নার মাঝে আলতো হেসে বোনের বুক পাঁজরে আলতো কিল বসায়। প্রাপ্তি অস্ফুট স্বরে বললো, নম্রু ফুচকা খাবি? নম্রতা যেনো আগের সময়গুলোতে ফিরে গেলো৷ যেই সময়গুলোতে নম্রতা, প্রাপ্তি আর আরো একজন ফুচকার প্রতিযোগিতা লাগাতো। প্রাপ্তি আবার বললো, কিরে কি এতো ভাবছিস? ফুচকা খাবি? নম্রতা বললো হুম।
কলেজ গেইটে যেতেই ফুচকার স্টলে চোখ যায় রিত্তিকের। মুখে আনমনেই বেরিয়ে আসে নীল পরী! আয়মা গেইট দিয়ে তাড়া দিচ্ছে ওহ ভাইয়া তাড়াতাড়ি আসোনা…
আজ তৃপ্তি মিটিয়ে দুই বোন ভালোবাসার কিছু সময় কাটিয়েছে। নম্রতা প্রাপ্তির দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। আর ভাবছে আমার বোনটাতো এমন হাসি মুখেই থাকতে চেয়েছিলো তা হয়নি কেনো? ফুচকা খেতে খেতে প্রাপ্তি হঠাৎ নম্রতার দিকে তাকিয়ে দেখলো নম্রতা এক মনে তাকে দেখছে। প্রাপ্তি তখন বললো, আমি জানিতো আমি অনেক কিউট তা এইভাবে কি দেখার আছে মিস? নম্রতা হেসে ফেললো। কতদিনের জমানো এই হাসি শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তায় জানেন।
বেতন দিয়ে গেইটের সামনে এসে রিত্তিক এর চোখ গুলো বার বার খুঁজছে তার নীল পরীকে৷ হঠাৎ দেখলো প্রাপ্তি নম্রতাকে জড়িয়ে ধরে চলে গেলো। রিত্তিক বললো ইশ আরেকটু আগে আসলেই হতো। রিত্তিকের চোখ যায় নম্রতার দিকে। মেয়েটা কাঁদছে। তাহলে কি মেয়েটা আমার নীল পরীর কাছের কেউ? তাহলে এই মেয়েটার থেকেই জানতে হবে আমার মায়াবী হুর পরীর কথা।
আয়মানের পাশে বসা মেয়েটা খুব ইনোসেন্ট দেখে আয়মান নিজেই তার সাথে কথা বলে নিলো
আয়মানঃ হাই আমি আয়মান খান্না। তুমি?
মেয়েটাঃ আমি নম্রতা।
আয়মান হেসে বললো, বাহ সুন্দর নামতো। নম্রতাও বিনিময়ে একটা হাসি দিলো। আয়মান বললো, ফুচকা খাচ্ছিলে যে? ওইটা তোমার কি হয়? নম্রতা বললো, বোন হয়। আয়মান হেসে বললো তুমি যেমন কিউট তোমার আপুটাও অনেক কিউট। নম্রতা বললো, তুমিও অনেক কিউট আয়মান। আয়মান হেসে বললো থেংকইউ। আচ্ছা তোমার বোনের নাম কি? নম্রতা শান্ত স্বরে বললো, প্রাপ্তি।
প্রাপ্তি! আমার হুর পরীর নাম প্রাপ্তি! যাক আমার হুর পরীর নামটাতো এটলিস্ট জানা গেলো!এইটাই অনেক। আর আমার শালীকার নাম নম্রতা বাহ দুই বোনের নাম যেমন মাশাল্লাহ দেখতেও মাশাল্লাহ.. বলতে বলতে একরাশ হাসে রিত্তিক।
আসলে হয়েছে কি..রিত্তিক নম্রতার দিকে তাকিয়ে দেখলো নম্রতা আয়মানের ক্লাসে ডুকছে। তাই আয়মানকে ডেকে বললো, ওই মেয়েটাকে বলবি ওর নাম কি? ফুচকা যে খাচ্ছিলো ওর সাথের মেয়েটা ওর কি হয়। আয়মানও ভাইয়ের কথামতো তাই করে। যদিও আয়মান ভেবে বসে তার ভাই নম্রতার প্রেমে পড়েছে। আসলেতো অন্য কিছু।
প্রাপ্তি রাতে বাসায় ফিরতেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ক্লান্ত শরীরের ভারটা আর যেনো সে নিতেই পারছেনা। ফাতেমা বেগম এসে বললেন,কিরে নম্রতার সাথে দেখা হলো? প্রাপ্তি বললো,হুম দেখাতো হয়েছেই। নম্রতাকে নিয়ে চিন্তারতো আর শেষ নেই। সুন্দর মেয়ে তাছাড়স জানোইতো ওইদিকের রাস্তা ঘাটও তেমন ভালো নয়। ফাতেমা বেগম বললো, একটা ভালো বিয়ে টিয়ে পেলে দিয়ে দিলে হয়না? প্রাপ্তি আগের ন্যায় উত্তর দেয় নাহ্ আমার বোন পড়বে। ডক্টর হবে।
নম্রতা ফেইসবুকিং করছে..আবারো তার ভালো লাগার মানুষটা মেসেজ দিয়েছে। আজ থেকে কয়েকমাস আগে “ইনোসেন্ট বয়” নামের একটা ছেলের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। নম্রতা একসেপ্ট করার সাথে সাথে মেসেজ দেয় আসসালামু ওয়ালাইকুম। নম্রতা সচরাচর কোনো ছেলের মেসেজের রিপ্লাই দেয়না যেহেতু ছেলেটা তাকে সালাম দিয়েছে তাই রিপ্লাই দিয়ে বললো,”ওয়ালাইকুম সালাম। এর পরে ছেলেটা অনেক মেসেজ দিলেও নম্রতা আর সিন করেনি৷ এর কয়েকদিন পর ছেলেটা একটা মেসেজ দিয়েছিলো তাই নম্রতা বাধ্য হয়প সিন করতে হয়। মেসেজটা ছিলো এমন
“কম কথা বলা মানে এটিটিউড নয় আমি জানি হয়তো আপনি খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে তাই হয়তো কথা কম বলেন।
নম্রতার এই কথাটা খুব ভালো লাগে। তাই রিপ্লাই দিয়ে বলে বাহ্ আপনি দেখছি কিছুটা বলে বুঝতে পেরেছেন আমাকে৷ বুঝার জন্য ধন্যবাদ। সাথে সাথে সেই ছেলেটি রিপ্লাই দিলো..আপনাকেও ধন্যবাদ আমার মেসেজ সিন করার জন্য। নম্রতা আবার মেসেজ দিয়ে বললো, সাথে সাথে রিপ্লাই! আমার মেসেজের অপেক্ষা করছিলেন নাকি? ছেলেটির ছোট উত্তর,” হয়তো”
নম্রতা বললো..আপনার নাম? ছেলেটি বললো, রওনক। আপনার নাম? নম্রতা বললো,নম্রতা।
এই থেকে শুরু হয় তাদের কথোপকথন। কখন যে নম্রতার মনে রওনক জায়গা করে নিয়েছে তা সে নিজেও জানেনা।
মিসেস ইয়ামিনি একটা ছবি দেখে কান্না করে বলছে, “আমার ছেলেমেয়েরা আমার পরিচয়েই বড় হয়েছে মিস্টার আর্জিব রাইদি। আমি দেখিয়ে দিয়েছি আপনি ছাড়াও আমি পারি চলতে।
আয়মান মায়ের হাতে নিজের বাবার ছবি দেখে তার মায়ের হাত থেকে নিয়ে ছোড়ে ফেলে দেয় ফ্লোরে। ইয়ামিনি জোরে বলে উঠলো,আয়মান..
আয়মান বললো,জন্ম দিলেই পিতা হওয়া যায়না মা ওনি পিতা সমগ্রের কলংক৷ ওনার ছবি এইখানে কেনো? ভাইয়া জানতে পারলে কি হবে জানো? মিসেস ইয়ামিনি বললেন,যতোই হোক এই মানুষটাতো তোদের বাবা। আয়মান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,বাবা! কোন বাবা? যেই বাবা জন্মের পর বাবা ডাকার সুযোগটা আমাদের দেয়নি? যেই বাবা আমাদেরকে ফেলে আরেকটা বিয়ে করে? দিক্ষা জানাই এইসব বাবাদের। এইটা বলেই রুম থেকে বড় বড় পা ফেলে চলে যায় আয়মান।
চলবে……