সাজু ভাই! (পর্ব:-০৫)কাছে আসার গল্প

0
1980

সাজু ভাই! (পর্ব:-০৫)

যখন চোখ মেলে তাকালাম, তখন একটা শক্ত খাটের উপর শুয়ে আছি আমি। বহুকষ্টে বিছানায় উঠে বসলাম, চারিদিকে তাকিয়ে কিছুই যে চিনতে পারছি না। এখানে আমি কীভাবে এলাম? হঠাৎ করে এসব ভাবতেই গতকাল রাতের আঁধারে সেই কথা মনে পরে গেল।

মা কোথায়? মাকে কি তারা কিছু করেছে? আর আমাকে এখানে কে এনেছে? বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে গেলাম, আগেই বুঝতে পারছি যে দরজা বাহির থেকে বন্ধ। একটা জানালা আছে সেটা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি অনেক বড় জঙ্গলের মতো দেখা যাচ্ছে।

ঘন্টা খানিক পরে রুমের মধ্যে একটা ছেলে প্রবেশ করলো, ছেলে নাকি পুরুষ সেটা বোঝা যাচ্ছে না কারণ তার মুখ কালো কাপড় দিয়ে মুড়ানো। এবং সম্পুর্ণ শরীরে কালো পোশাক পরা, তার সঙ্গে যে কি বলবো সেটাই বুঝতে পারছি না।

– লোকটা বললো, জ্ঞান ফিরেছে তাহলে? তোমার নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে?

– কে আপনি? আর আমাকে এখানে কেন ধরে নিয়ে এসেছেন?

– এতো উত্তেজিত কেন? তোমাকে আমরা কিছু করবো না, তুমি খাবে দাবে ঘুমাবে। তোমার সকল বান্ধবীরা মারা যাবার পরে তোমাকে তোমাকে খুন করা হবে। সুতরাং আপাতত তুমি কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারবে, যতদিন বেঁচে আছো ততদিনে তোমাকে কেউ অত্যাচার করবে না।

– আমি দুচোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললাম, কিন্তু আমরা কি ক্ষতি করেছি। কেন আমাদের এভাবে এক এক করে খুন করছেন আপনারা? আমাদের মা-বাবার কষ্টের কথা চিন্তা করুন।

– আমাদের একজন নেতা আছে এবং আমরা তার নির্দেশে সবকিছু করে থাকি। তোমাদের দোষ ত্রুটি সবকিছু তিনি জানেন, আমরা তো শুধু তার হুকুম পালন করি।

– আপনাদের নেতার নাম কি?

– জানতে চাও? আচ্ছা সমস্যা নেই তুমি জানতে পারবে, তবে বসের কাছে জিজ্ঞেস করে তারপর তোমাকে সবকিছু জানাবো। এখন বলো তুমি কি খাবে? তোমার জন্য যেকোনো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি, এটা বসের হুকুম।

– মরেই যখন যাবো তখন আর তোমাদের মতো খারাপ মানুষের খাবার খেয়ে লাভ কি? তোমরা খুব খারাপ মানুষ, তোমাদের মা-বাবা যদি মারা গিয়ে থাকে তাহলে তারা কবরে নিশ্চয়ই এগুলোর ফল পাচ্ছে।

– এতো নীতি গল্প আমাদের কানে যায় ঠিকই কিন্তু আবার বেরিয়ে যায়, সুতরাং শুধু শুধু এসব বলে লাভ নেই তোমার। ঠিক আছে তুমি অপেক্ষা করো আমি নাস্তার ব্যবস্থা করি, রেখে দিয়ে যাবো তুমি ইচ্ছে হলে খেয়ে নিও।

লোকটা বের হয়ে যাবার পনের মিনিট পরে ফিরে এসে নাস্তা নিয়ে, দরজা খুলে টেবিলের উপর রেখে আবার চলে গেল। কিন্তু দরজা বন্ধ করার আগে মুখ বাড়িয়ে বললো;-

– আমাদের নেতা হচ্ছে তোমার খুবই পছন্দের মানুষ সাজু ভাই। যাকে তুমি কত কৌতূহল নিয়ে দেখতে চাইতে, সেই সাজু ভাই হচ্ছে আমাদের সবার বস৷ তোমাদের সকলের মধ্যে তুমি দেখতে খুব সুন্দরী, তাই হয়তো তোমার উপর কিছু আদর যত্ন হতে পারে। বাকি খুনগুলা করতে বেশ কিছু দিন থাকতে হবে সাজু ভাইকে, তাই এরমধ্যে যদি মনটা খারাপ লাগে তাহলে তোমাকে আদর করতে আসতে পারে। তুমি তৈরী থেকো।

লোকটা কথাটা বলে দরজা বন্ধ করে চলে গেল, আর আমি আকাশ থেকে পরলাম। সাজু ভাই এসব করেছে? আমাকে এখানে সাজু ভাই ধরে নিয়ে এসেছে? কিন্তু কেন? সাজু ভাই আমাদের সকল বান্ধবীদের কেন খুন করবে? আমাদের কি তিনি চিনেন? যদি না চেনে তাহলে তিনি আমাদের হত্যা করতে চায় কেন? আর আমার আগের চার বান্ধবীকে তো সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করেছে তাহলে আমাকে খুন না করে এখানে ধরে এনেছে কেন?
আদর করতে? যে মানুষটা এতো সুন্দর করে গল্প লিখতেন তার মন এত কুৎসিত? এতকিছু করে তিনি কি লাভ পাবেন?

উপরের এতগুলো প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না, আমাকে কখন খুন করা হবে সেটাও বলতে পারি না। হয়তো যেকোনো মুহূর্তে আমাকেও বান্ধবীদের কাছে চলে যেতে হবে। কিন্তু তাদের হাতে খুন হবার আগেই নিজেও আত্মহত্যা করতে পারি। কারণ এখন পর্যন্ত ইজ্জত বেঁচে আছে কিন্তু যদি সত্যি সত্যি শারিরীক নির্যাতন করে তাহলে তো আরও কষ্ট লাগবে। তারচেয়ে নিজের ওড়না দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারি, যাতে ইজ্জত নিয়ে মরতে পারি। আচ্ছা নিজের ইজ্জত বাঁচাতে যদি আত্মহত্যা করি তাহলে কি পাপ হবে?

কাগজ ফুরিয়ে গেছে তাই আর বেশি সামনে গিয়ে লাভ নেই। এখানে এসেছি তিনদিন হয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত খাচ্ছি আর ঘুমাচ্ছি, আতঙ্কে মৃত্যুর প্রহর গুনে যাচ্ছি। সাজু ভাইয়ের সঙ্গে এখনো দেখা হয় নাই, গ্রামের মধ্যে কি চলছে সেটাও জানি না। আমিও বাঁচবো কিনা জানি না। আমার বিছানার তোষকের নিচে একটা কলম আর এই কাগজটা পেলাম তাই খুনের বিষয় সবটুকু লিখে দিলাম। জানলা দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিচ্ছি, যদি কোন সহৃদয়বান ব্যক্তির হাতে পরে তাহলে আমাদের গ্রামের মধ্যে গিয়ে সবাইকে বলবেন যে সাজু ভাই সবকিছুর জন্য দায়ী। আমি হয়তো বেঁচে থাকতে পারবো না, আর খুনের রহস্য বের হয়েছে নাকি বাকি সবাই খুন হয়েছে? সাজু ভাই কি ভদ্রতার মুখোশ পরে গেল? নাকি তার পাপের বিনাশ হয়েছে?

আমার লেখাটা পাওয়া মাত্র আপনি এটা নিয়ে আমাদের গ্রামের মধ্যে যাবেন অথবা আমাদের উপজেলার সেই দারোগা সাহেবের কাছে আমার লেখাটা দেখাবেন। ভালো থাকবেন।

– – – – –

এতক্ষণ ধরে রুহির লেখা কাগজের সম্পুর্ণ লেখা পড়ছিল জামিল নামের একটা ছেলে। সে একজন চোর, গতকাল রাতে পাবলিকের ধাওয়া খেয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে এই শালবনে ঢুকেছে। সকাল বেলা এই পরিত্যক্ত বাড়িটার কাছ দিয়ে যেতেই কাগজটা চোখে পরে তার। জামিল তখন যাচ্ছিল এবং উপর থেকে কাগজটা পরছিল তার সামনে। সে তখন আৎকে উঠেছে কারণ এখানে কেউ বাস করে জানা ছিল না।

ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করা জামিল যখন রুহির সেই বান্ধবীদের প্রথম শিকার থেকে চতুর্থ শিকার পর্যন্ত খুন হওয়া পর্যন্ত পড়ছিল তখন তার ভয় করছিল। জামিল একবার মাথা তুলে জানালা বরাবর তাকাল কিন্তু জানালা বন্ধ। প্রথমে সে ভেবেছিল বাড়ির মধ্যে গিয়ে মেয়েটাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। যেহেতু কাগজটা মাত্র উপর দিয়ে পরেছে সেহেতু মেয়েটা এখনো বাড়ির মধ্যে আছে এবং সুরক্ষিত।

কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো এটা কি ঠিক হবে আমার জন্য? এখানে বাড়ির মধ্যে নিশ্চয়ই সেই খারাপ লোকগুলো রয়েছে, তারা যদি জামিলকে মেরে ফেলে তাহলে তো রুহি নামে মেয়েটার এই চিঠি পৌঁছাবে না। তাই এখন সংঘর্ষে না জড়িয়ে বরং চুপিচুপি মেয়েটার এলাকায় যেতে হবে। আর দারোগা সাহেবের কাছে সবকিছু বলে এখানে নিয়ে আসতে হবে। তার মতো চোরের মাথায় এত বুদ্ধি বাহহ, নিজেকে সে প্রশংসা করলো।

চন্দ্রা থেকে সরাসরি টাঙ্গাইলের বাসে উঠে জামিল রুহিদের উপজেলা থানায় এসে পৌঁছাল। থানায় জিজ্ঞেস করে মোতালেব দারোগাকে খুঁজে বের করলো কারণ রুহি তার নাম লিখেছে। বুকের কাছে নাম লেখা দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল যে সত্যি সত্যি তিনি মোতালেব দারোগা। তারপর জামিল চোরা দারোগা সাহেবের কাছে সামান্য বিবৃতি করে জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া রুহির কাগজটা দিল।

দারোগা সাহেব কাগজটা পড়ে থ হয়ে গেল, চোখ বড় বড় করে বললোঃ-

– জঙ্গলটা কোনদিকে?

– স্যার আপনি চলেন আমি আপনাদের নিয়ে যাবো সেখানে, মেয়েটা এখনো মনে হয় বেচে থাকতে পারে।

দারোগা সাহেব তখন জামিল চোরাকে নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে গেল। থানার সামনে হোটেলের মধ্যে গিয়ে দুপুরের খাবার অর্ডার করে মোবাইল বের করে সাজুকে কল দিয়ে আসতে বললো।
জামিল চোরা অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও দারোগার চোখের দিকে তাকিয়ে চুপসে গেল। কারণ পুলিশের চোখের দিকে তাকিয়ে সে অনেক কিছু কল্পনা করতে পারে।

১০ মিনিটের মধ্যে সাজু ভাই এবং হাসান সাহেব সেখানে উপস্থিত হলেন। তারা তখন উপজেলার মধ্যেই ছিল এবং কল পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে তারা এসেছে। জামিল চোরা গতকাল রাত থেকে কিছু খায়নি তাই এখন পেটপুরে খাচ্ছে। দারোগা সাহেব কাগজটা সাজু ভাইয়ের হাতে দিলেন, এবং শুধু শেষে কিডনাপের পর থেকে লেখা অংশ পড়তে বললেন কারণ বাকিটুকু তাদের জানা। সাজু ভাই ও হাসান দুজনেই তবুও সম্পুর্ণ লেখা পড়লো, সাজু ভাই তখন দারোগা সাহেবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল। হাসান সাহেব তখন কিছুটা গম্ভীর ভাব নিয়ে মাথা চুলকাতে আরম্ভ করলো। আর মুরগির মাংস দিয়ে খেতে খেতে তাদের সেই তামাশা দেখছিল জামিল চোরা।

সে ভাবলো, এই সেই সাজু ভাই? ইনি তাহলে মেয়েটাকে সেখানে বন্দী করে রেখেছে? মেয়েটার আর্তচিৎকার কানে যায় না তার? আর দারোগা সাহেব তাহলে খুনের সঙ্গে জড়িত? তিনি কি সকল সাহায্য সহোযোগিতা করছে?

জামিল চোরা পানি ঢেলে হাত ধুয়ে নিচ্ছে তখন সাজু ভাই ও হাসান সাহেব উঠে দাঁড়াল। তারপর দারোগা সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো ” সময় হলে আপনাকে ডাকবো, এখন চলি অনেক কাজ করতে হবে। ”

জামিল বুঝতে পারছে না, সময় হলে ডাকবে এর মানে কি? কাগজটা দিয়ে তিনি কোন ব্যবস্থা না করে সরাসরি খুনির হাতে দিয়েছে তাই তার পুরষ্কার দিবে সাজু ভাই?

একটু পরে দুজন পুলিশ এসে জামিল চোরাকে ধরে নিয়ে গেল, দারোগা সাহেব তাকে বললো যে তুমি আপাতত হাজতে থাকো। তোমাকে আমরা এই মুহূর্তে বাহিরে ছাড়তে পারবো না, খুব রিস্ক।

– – – –

রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে।
রুমের মধ্যে বিছানায় শুয়ে ছিল রুহি, হঠাৎ করে দরজা খোলার শব্দে সে লাফ দিয়ে উঠলো। আর দরজার দিকে যখন তাকাল তখন তার চোখ বিস্ময়ে, ভয়ে, আতঙ্কে একদম বন্ধ হয়ে গেল। কিছু একটা বলার জন্য ঠোঁট নড়তে চাইছে কিন্তু সে কিছু বলতে পারছে না। কারণ দরজা খুলে সাজু ভাই প্রবেশ করেছে, এবং তার দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর হাসি দিচ্ছে।

– সাজু ভাই বললো, কেমন আছো রুহি?

– রুহি বহু কষ্টে বললো, সাজু ভাই….

– হ্যাঁ আমি, কেন তোমাকে আমার লোকজন বলে নাই আমি কথা?

– মানে কি সাজু ভাই?

– তোমাকে কিসের জন্য যেন তৈরী থাকতে বলা হয়েছে মনে নেই? তুমি তৈরী তো?

.

.

চলবে…

.
.
.

লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here