ভাড়াটে-শেষ পর্ব

0
433

ভাড়াটে-শেষ পর্ব

আয়রার ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হলো না। মেয়েটার প্রতি কনকের এক অদ্ভুদ আগ্রহ আমার চোখে স্পষ্ট বিঁধেছিল। সেই অদ্ভুদ আগ্রহ আমাকে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিলো না। ভেতরে ভেতরে অচেনা ব্যথায় কাতর করে দিলো। কারণে-অকারণে কনকের প্রতি রাগ, কষ্ট, উদাসীনতা সব প্রকাশ পেতে লাগলো। কেমন যেন হয়ে গেলাম আমি। কেন হলাম? আমি নিজেও ঠিক জানি না। শুধু জানি, ওই সকালটা আমার প্রশান্তি ছিনিয়ে নিয়েছিল। আমার আমিটাকে পালটে দিয়েছিল।
কনকের দিকে সকাল, বিকাল, রাত— প্রায়ই তাকিয়ে থাকতাম আমি। অনুভব করতাম, কনক আসলে আমাকে একটুও পছন্দ করেন না। দূরে থাকতে চান। অথচ মেয়েটার প্রতি তার আকর্ষণ ছিল অন্যরকম। যা আমাকে জ্বালাতো, যন্ত্রণা দিতো। তারপর একদিন বুঝতে পারলাম, আমি কনককে ভালোবাসি। কনকের প্রতি আমার আকর্ষণ প্রথম থেকেই ছিল। দেখতে শুনতে সুন্দর তো! সেখান থেকেই এই আকর্ষণের সৃষ্টি। কিন্তু শত্রুতা দাপিয়ে সেটা প্রকাশ পেতে পারেনি। চাপা পরে গিয়েছিল। ঝগড়া করতে করতেই হয়তো এভাবেই কোনো একদিন ওর প্রতি দূর্বল হতেও শুরু করে দিয়েছিলাম আমি।
কনক আমার এমন নিশ্চুপ আচরণ প্রতিবারই খেয়াল করতেন। বিশেষ করে আমি যখন ঝগড়ার বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতাম, শান্ত থাকতাম।

রুমের এককোণে বাগা আর লিউইস ভদ্রদের মতো বসে আছে। খাবারের অপেক্ষায়। আমি তাদের বাটিতে খাবার বাড়তেই ওরা যেন মুখিয়ে উঠলো। খুব দ্রুততার সঙ্গে খেতে শুরু করলো। যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে ওরা। কে কার আগে খেতে পারে! বলা হয়নি, লিউইস আর বাগার মাঝে কিভাবে যেন বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সারা বাড়িময় একসাথে কোমড় দুলিয়ে দুলিয়ে টো টো করে বেড়ায় এরা। বাগাকে নিয়ে আমার ভয়টাও এখন খানিকটা কমেছে।
হাত বাড়িয়ে দুজনের গায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। কনক তখন বাহিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। আমার দিকে চেয়ে বললেন, “ধিন্দির মন খারাপ যে? পাশের বাসার গাছ থেকে বুঝি আম চুরি করতে পারোনি? নাকি ধরা পরে মার খেয়ে এসেছো?”

তার ঠাট্টায় কান দিলাম না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভাবে তাকে চেয়ে চেয়ে দেখলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দৃষ্টি তক্ষুণি সরিয় নিলাম আবার। লোকটা আজকাল দেখছি আমাকে নিয়ে ভাবেও!
জবাব না পেয়ে ভ্রু কুঁচকালো কনক। আবার বললো, “কথা বলছো না কেন ধিন্দি? ইদানিং ধরে তুমি এমন অদ্ভুদ আচরণ করেই যাচ্ছো। কথা বলছো না, ঝগড়া করছো না, আকামও করছো না! কি হয়েছে?”
লিউইসের কাছ থেকে উঠে দাঁড়ালাম। রুম থেকে বের হতে হতে বললাম,
—“কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।”

কনক আমাকে যেতে দিলেন না। আচমকা হাত ধরে বসলেন। টের পেলাম, খুব শক্ত করেই হাতটা ধরেছেন। যেন রাগের সুপ্ত বহিঃপ্রকাশ। ক্ষিপ্ত মেজাজে ঝাঁঝ নিয়ে শুধালেন, “রাগাচ্ছো কেন মেয়ে? সোজাসোজু উত্তর দিতে পারো না?”

আমি হাত টেনে নিতে চাইলাম। সে আরও বল প্রয়োগে ধরলেন যেন। তপ্ত শ্বাস ফেলে তার দিকে শান্ত দৃষ্টে চেয়ে উত্তর দিলাম, “কিছু হয়নি বলেছি না? হাত ছাড়ুন। আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন।”
—“আমি বিরক্ত করছি?” অবিশ্বাসেরা যেন এক এক করে কণ্ঠে তুমুল ভীড় জমালো। কিন্তু হাত তবুও ছাড়লেন না কনক। আমার নেত্রের খুব গভীরে চেয়ে কি যেন খুঁজলেন, পরখ করলেন। অতঃপর নরম গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
—“তুমি কিছু লুকাচ্ছো ধিন্দি। কি লুকাচ্ছো? কলেজে কেউ তোমাকে ডিস্টার্ব করছে? বখাটে লেগেছে পিছনে? কেউ কিছু বলেছে? বলো!”

আমি চেয়ে চেয়ে তার উদ্বিগ্নতা দেখলাম। সে আমাকে পছন্দ করে— এ ভেবে ভ্রমও হলো একবার। হাসলাম মনে মনে। অবচেতন মন হুট করে জানতে চাইলো, “আয়রার সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”
কনক একটু থমকালেন। এমন প্রশ্ন আশা করেননি। তবুও নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে বললেন, “আমার ফ্রেন্ড।”
—“কেমন ফ্রেন্ড?”
—“কেমন ফ্রেন্ড আবার কেমন? শুধু ফ্রেন্ড।”
—“শুধু ফ্রেন্ডদের হাতে হাত রেখে মানুষ বুঝি রাস্তায় হাঁটে?”

প্রশ্ন শুনে ভ্রু বাঁকালেন কনক। বোঝা গেল, বিরক্ত হয়েছেন। অথচ গলার স্বর শুনে তা ঠাওর করা গেল না।
—“ও পছন্দ করতো আমাকে।”
—“আপনি করতেন না?”
কনক তার শীতল আঁখিজোড়া আমার আঁখির সাথে মিলিয়ে তাকালেন। ভয়ংকর ঠান্ডা দৃষ্টি! মনে মনে হাঁপিয়ে গেলাম, কাঁপলাম ভয়ে। উত্তরের অপেক্ষা করলাম। সে ছোট্ট করে উত্তর দিলো, “করতাম।”

আমি কিন্তু কথাটা জানতাম। কনকের বাবা কথায় কথায় বলেছিলেন একবার। তখন যতটা না কষ্ট পেয়েছিলাম, কনকের নিজ মুখে বলা স্বীকারোক্তিতে আরও বাজেভাবে ভেতরটা কষ্ট পেল।
জোড় করে কনকের কাছ থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। তাচ্ছিল্যের ক্ষীণ রেশ ফুঁটে উঠলো অধরের কোণ ঘেঁষে। যাওয়ার আগে কনকের মুখপানে সেই তাচ্ছিল্য ভরা চাহনি নিক্ষেপ করে বলেছিলাম, “ওহ্! আচ্ছা।”

আমি কিন্তু কনককে কখনো তাচ্ছিল্য করিনি। করেছি নিজেকে। নিজের অনুভূতিকে।

দিন দিন আমার বদলানো স্বভাব কনককে অধৈর্য করে তুলছিল। আমার সাথে একটু কথা বলার জন্য সে তীর্থেরকাকের মতো অপেক্ষা করতেন। আমি বুঝতাম। কিন্তু এড়িয়ে যেতাম। আমি আসলে আমার অনুভূতিটুকু নিজের মাঝে চাপা দিতে শুরু করেছিলাম। তার কাছাকাছি যেতে চাইতাম না কারণ, কাছে গেলেই যদি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি? সব বলে দেই?
আমার হুট করে শান্ত হয়ে যাওয়াটা দু’পরিবারের মানুষও খেয়াল করেছিলেন। আম্মু আর শ্বাশুড়ি মা বেশ কয়েকবার কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সান্ত্বনা দিলেন। বারবার জিজ্ঞেস করতেন, “কি হয়েছে? মন খারাপ কেন? কনক কিছু বলেছে?”
তাদের প্রশ্নগুলো আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম। বলতাম, “কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। ভালো আছি।”

রাতে ঘুমানোর সময় কনক জোড় করে আমাকে নিজের দিকে ফিরালেন। শক্ত কণ্ঠে তেজি ধমক দিলেন, “ধিন্দি! বেশি বেশি হচ্ছে কিন্তু! সমস্যার কথা না বললে আমি বুঝবো কিভাবে?”
আমার মাথা ব্যথা করছিল খুব। ঘুমে চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছিল। পাশ ফিরে শুতে শুতে বিরক্ত কণ্ঠে বললাম,
—“বললেও কিছু বুঝবেন না। ঘুমান।”
সে মানলেন না। বাহু টেনে ধরলেন। জোড়াজোড়ি করলে আচমকা চড় বসিয়ে দিলেন আমার ডান গালে। আমি থমকে গেলাম। অবাক নয়নে চেয়ে থেকে তিন’চারবার পলক ঝাপটালাম। আওড়ালাম, “আপনি আমাকে মারলেন কেন?”
—“কথা শুনছিলে না কেন? তুমি আমাকে রাগাচ্ছো!”
নিমিষেই মেজাজ বিগড়ে গেল। ঘুম-টুম সব বাদ। সে আমার গায়ে হাত তুললোটা কিভাবে? ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠলো দারুণ রাগে। নিশ্বাসের আনাগোনা এত দ্রুত! ফিসফিস শব্দে চেঁচিয়ে উঠলাম,
—“আরও রাগাবো! আপনি কোন সাহসে মারবেন আমাকে? ছাড়ুন! ছাড়ুন আমার হাত। এত বেয়াদব কেন আপনি? বাজে লোক! কারো অনুভূতির কোনো দাম নেই আপনার কাছে। কিচ্ছু বুঝেন না আপনি। অবুঝ, বেহায়া, নিষ্ঠুর লোক—”
—“ধারা।”
শরীরের লোম দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মতো ঠান্ডা ডাক। মুহুর্তেই শান্ত হয়ে আমি অনুভব করলাম, আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। ভীষণ বিশ্রী তোলপাড়ে নেতিয়ে যাচ্ছি আমি। কিছুক্ষণ আগের দ্রুত নিশ্বাসটা এখন খুব আস্তে আস্তে চলছে। সুযোগ বুঝে কনক আমাকে কাছে টেনে নিলেন। তার প্রশস্ত বুকে একটুখানি মাথা গুজার ঠায় হলো আমার। চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে সে ক্ষীণ করে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “আমি কি করেছি ধিন্দি? আমার ওপর রাগ করেছো কেন?”

আমি ততক্ষণে তার গেঞ্জি একটু একটু করে ভিঁজিয়ে দিচ্ছি। একটা খুব ধীর ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দ নিস্তব্ধ রুমটাকে ভৌতিক, রোমাঞ্চকর করে তুলছে। ক্রমশই নিজের শক্ত আবরণ থেকে বেরিয়ে আসছিলাম।
তার গেঞ্জির একপাশ ভীষণ ভাবে খামচে বললাম,
—“আপনি আয়রাকে খুব ভালোবাসেন, তাই না?”
—“নাহ্।”
—“আপনি মিথ্যে বলছেন। আমি জানি।”
—“আমি ওকে কখনোই ভালোবাসিনি ধিন্দি। পছন্দ করতাম শুধু।”
—“ওই মেয়েটা ভালোবাসতো?”
—“কি জানি! তবে মনে হয় না। ভালোবাসলে তো আমার বাসায় এসে বিয়ে নিয়ে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিতো!”
কনক হাসছেন। শব্দ করে। আমি চুপ করে রইলাম। এ কথার পিঠে আর কিছু বললাম না।

সময় গড়ালো। কনকের হাসি থেমে গেছে অনেকক্ষণ হলো। সে নিশ্চুপ হয়ে কি যেন ভাবছেন। ভাবা শেষে নিদারুণ গাম্ভীর্য নিয়ে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি আমাকে পছন্দ করো ধিন্দি?”
মিথ্যা বললাম না। লুকানোর মতো আর কিছু বাকিও নেই।
—“নাহ্। ভালোবাসি।”
আবারও কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন সে। আগের মতো বললেন, “আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি না।”
—“জানি।”

কনক দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। আমি বুঝতে পেরেছি। কোমলস্বরে তিনি বলতে লাগলেন,
—“আমাদের বিয়েটা আচমকা হয়েছিল ধিন্দি। আমি প্রস্তুত ছিলাম না। মেনেও নেইনি প্রথমে। কিন্তু এখন মেনে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমার বিশ্বাস, কোনো একদিন আমি তোমাকে ভালোবাসবো। সেটা শুধু পছন্দের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সত্যি, সত্যি ভালোবাসা হবে।”

সে একটু থামলেন। সময় নিয়ে আবার বললেন, “তুমি কিন্তু আমার ভীষণ বাজে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছ ধিন্দি। তোমার সাথে কথা না বললে, ঝগড়া না করলে— আমার আর এখন ভালো লাগে না।”

পুরোটা সময় আমি চুপ করে ছিলাম। কিছু বলিনি। একটু একটু করে লেপ্টে ছিলাম কনকের সাথে। আবারও মাথা ব্যাথা করলো, ঘুম পেল। তীব্র প্রশান্তিতে ভেতরটা ঝিমিয়ে উঠলো। মনে মনে হয়তো আমিও বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম, একদিন কনক আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসবেন। আশাতেই তো মানুষের বসবাস। আমি নাহয় আশা নিয়েই ভালো থাকবো।

আমি ঘুমিয়ে যাচ্ছিলাম। কনক আলতো করে ডাকলেন,
—“ধিন্দি? ঘুমিয়ে গেছ?”
—“হু।”
—“আমার ভালো লাগছে না। চলো ঝগড়া করি।”
তন্দ্রার অতলে তলিয়ে যেতে যেতে আমি বিড়বিড়ালাম, “সকালে। এখন ঘুমাবো।”

আমাদের গল্পটা হয়তো এমনই হওয়ার ছিল। টক, ঝাল, মিষ্টির মাঝে একটুখানি অশান্তি, শান্তি আর ভালোবাসা।

___________________

সমাপ্ত~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here