বেসামাল_প্রেম #জান্নাতুল_নাঈমা #পর্ব_৫৮

1
1317

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫৮

দাদিনের শারীরিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। অথচ বাড়ির কেউই এ ব্যাপারে অবগত নয়। এই বৃদ্ধা বয়সে এসে আজ তার মনের কোণে অভিমান জন্মেছে। বড্ড বেশি অভিমান৷ সেই অভিমান থেকেই কাউকে জানায়নি। আজকাল তার শরীর ভালো যাচ্ছে না। এই অভিমান যার ওপর সে কি কখনো টের পাবে? এখন যে সে ভীষণ ব্যস্ত। আগামীকাল রুদ্র, হৈমীর ছেলেমেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসা হবে। তাই নিয়ে সকলের যত তোড়জোড়। নিজের ঘরে একাকী বসে আছেন দাদিন। তিনবেলা খাবার সময়ই তার খোঁজ করেন বড়ো বউমা। এছাড়া বাড়ির কারো সময় নেই দুদণ্ড তার কাছে বসার৷

এই পৃথিবীতে স্বার্থহীন মানুষ একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে বিশেষ কোনো জায়গায় প্রচণ্ড পরিমাণের স্বার্থপর। স্বার্থপরের পাশাপাশি আমরা মানুষরা বড়োই নির্ভরশীল প্রাণী। মানুষের পাশে স্বার্থপর আর নির্ভরশীল শব্দ দুটো বেশ শোভনীয়। এই যে দাদিন। এককালে তার স্বামী, সন্তান নিয়ে ভরা সংসার ছিল। তাদের জীবনে তার প্রয়োজনীয়তা ছিল অসীম। স্বামী, সন্তানের কেউই তাকে ছাড়া এক সেকেন্ডও কল্পনা করতে পারতো না। সময়ের বিবর্তনে আজ পরিস্থিতি বদলেছে। স্বামী পৃথিবী এবং তার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন পরপারে। এপারে সে সন্তানদের নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমেছে। তিন পুত্রকে বিয়ে করিয়ে সংসারী করেছে। ঝড়ঝাপটা পেরিয়েছে অনেক। বড়ো ছেলের করা ভয়াবহ অপরাধ ছিল সেই ঝড়ের সূত্রপাত। মেজ ছেলের পাশে থেকে নাতি, নাতনিকে সামলেছে এক হাতে। সেই সব দিন কি ভুলার মতো? সেইদিনও এই সংসারে সে অতীব প্রয়োজনীয় বস্তু ছিল। হ্যাঁ আমাদের সমাজে অধিকাংশ নারীরাই সংসারের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের মতোন। আজ দাদিনের নিজেকে এ বাড়ির এক ফেলনা বস্তু মনে হচ্ছে। যার প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে। তাই তো এত অবজ্ঞা! তার রুদ্র কত বড়ো হয়ে গেল! বাড়িতে বউ নিয়ে এলো। আগামীকাল বাচ্চাদের নিয়ে আসবে। কানায় কানায় ভরে ওঠবে সুখে। সেই সুখের একাংশেও কি থাকবে সে? নাহ থাকবে না। কারণ সে এখন রুদ্রর চোখে একজন স্বার্থপর মহিলা ছাড়া আর কিছুই না। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল দাদিন। আশপাশে তাকিয়ে মোবাইল ফোন হাতে নিল। বড়ো ছেলে দিলওয়ারের একাধিক বার মিসড কল! ইদানীং দিলওয়ারের ফোন ধরেন না তিনি। একবার ভুল করলে ক্ষমা করা যায়। কিন্তু একই ভুল বার বার করলে তার কোনো ক্ষমা হয় না। ফোনটা বেজে ওঠল আবারো। না চাইতেও রিসিভ করল দাদিন। তৎক্ষনাৎ ওপাশ থেকে ভেসে এলো দিলওয়ারের উতলা কণ্ঠস্বর,

-” মা ভালো আছো? ফোন ধরো না কেন? কী হয়েছে মা? ”

-” কী হওয়ার বাকি আছে আর? ”

অসহায় স্বর দাদিনের। দিলওয়ার মিনতি স্বরে বলল,

-” আমি কী করব বুঝতে পারছি না। আমি ফেঁসে গেছি মা। এখান থেকে বের হওয়া আর সম্ভব না। ”

-” বড়ো দুজনের দায়িত্ব নিতে হয়নি। তারা নিরাপদে ছিল, আছে। কিন্তু ছোটোটাকে তো জলে ভাসিয়ে দিলি। তোর কি মরার ভয় নাই? উপরে একজন আছে দিলু। ”

আঁচলে মুখ চেপে ডুকরে ওঠল দাদিন। দিলওয়ারের প্রথম স্ত্রীর সন্তান রাদিফ, সাদমান। বাবার ছায়া ছাড়াই তারা আজ বড়ো হয়েছে। রাদিফ একজন সফল ব্যবসায়ী। সাদমানের পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে জন্মানো রিমন? তার ভবিতব্য কী? রুদ্র, সূচনা, রাদিফ, সাদমান বিনা দোষে তারা একটি শূন্যতা নিয়ে বড়ো হয়েছে। কিন্তু জলে ভেসে যায়নি। অথচ রিমন সে যে জলে ভাসা। বাবা, মায়ের পাপের ফল সে কেন ভোগ করবে? ছেলেটা এখনো বাচ্চা। শুনেছে কলেজ ছাত্র। শতহোক তারই তো বংশধর। নিজেকে সামলাতে পারলেন না দাদিন। দিলওয়ার মা’কে শান্ত করতে বলল,

-” বিশ্বাস করো মা আমি ওদের জন্য করতে চাই কিন্তু পারি না। হাফিজা আমাকে চাপে রাখে। ওর বুড়ো বাপটা আস্ত শয়তান। ”

-” মা হয়ে বলতে কষ্ট হয় তবুও সত্যি আমি বলব। তুই তোর পাপের ফল ভোগ করছিস। ”

দিলওয়ার ঘনঘন শ্বাস ফেলল। দাদিন বলল,

-” তোর জন্য আমি অনেক করেছি। আমার থেকে তুই আর কিছু পাবি না দিলু। শেষ যা আছে আমি তোর ছোটো ছেলের নামে করে দিব। তুই আর আমার সাথে যোগাযোগও করিস না। রুদ্র আমার থেকে দূরে দূরে থাকে। রিমনের জন্য কিছু করলে এই দূরত্ব আরো বাড়বে। কিন্তু আমি কী করব! তোর মতো কু’লাঙ্গারকে পেটে ধরে আমিও তো বিপদে পড়েছি। ”

ফোন কেটে দিল দাদিন। শরীরটা ভালো লাগছে না। প্রেশার বাড়ছে বোধহয়। ত্বরিত প্রেশারের টেবলেট খেয়ে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল সে। মন আনচান করছে। আয়ুকাল বোধহয় খুব বেশি দিন নেই। যা করার শিঘ্রই করতে হবে। ইদানীং প্রয়াত স্বামীকে বেশ স্বপ্নে দেখে। যেন তিনি তাকে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন! ভাবতেই গা শিউরে ওঠল বৃদ্ধার। দু’চোখের কোণ ঘেঁষে ঝড়ল অশ্রুজল। পৃথিবীটা মায়ার নাকি পৃথিবীর মানুষগুলো?
__________________
সূচনা মা হচ্ছে! সদ্য মামা হওয়ার পর বাবা হওয়ার সংবাদ পেয়ে মাহেরের উচ্ছ্বাস দু-চোখ ভরে দেখেছে সূচনা৷ এবার সদ্য বাবা হওয়ার পর মামা হবার সংবাদ পেয়ে রুদ্রর উচ্ছাস দেখছে। আদরের ছোটোবোনটি মা হবে? বিস্ময়ে কণ্ঠরোধ হয়ে গেল রুদ্রর। দু’হাতে সূচনার গাল চেপে ধরে কপালে চুমু খেল। মাহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” অভিনন্দন। ওর খেয়াল রাখবেন সব সময়। ”

এরপর সূচনার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

-” যখন যা ইচ্ছে করবে বলবি আমায়। যা খেতে মন চাইবে শুধু একবার বলবি। আর শোন, এখানেই থাকবি। ও বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ”

তীব্র প্রতিবাদ জানালো মাহের। বলল,

-” উহুম, নো। আপনার থেকে এখন এমন কিছু আশা করছি না রুদ্র। আমার বউ আমার সন্তান ক্যারি করার পুরো সময়টাই আমার পূর্ণ সাপোর্ট পাবে। আর এরজন্য তাকে অবশ্যই তার বাড়ি থাকতে হবে। ইয়েস, তার বাড়ি শেখ বাড়ি নয় খান মঞ্জিল। ”

ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুদ্র। হৈমী রুদ্রর কুঁচকানো ভ্রু দেখে চট করে ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়াল। ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বলল,

-” কেমন লাগে? ”

রুদ্র কিঞ্চিৎ দমে গেল। আমতা আমতা করে বলল,

-” সে হবে… ”

ঈষৎ হেসে মাহের বলল,

-” ভাগ্না, ভাগ্নি আসার পর দিন দুয়েক থাকব আমরা৷ এরপর ফিরে যাব আশা করি আপত্তি নেই? ”

ঘোর আপত্তি থাকলেও হৈমীর ভাবসাব দেখে রুদ্র বলতে বাধ্য হলো,

-” নাহ, না আপত্তি নেই৷ ঠিকভাবে ওর যত্ন নিলে আমার কোনো সমস্যা নেই। ”

মাহের আশ্বস্ত করে বলল,

-” আপনার মতো মানুষ যদি এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রীর প্রতি এতটা যত্নশীল হতে পারে। তাহলে আমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারেন। ”

চোখমুখ অনুজ্জ্বল করে ‘ হুম ‘ বলে বোনের দিকে তাকাল রুদ্র। বলল,

-” বাইরে যাব মিষ্টি আনতে। আর কী খাবি বল? ”

-” মিষ্টি তো আমার আনবার কথা? ”

রুদ্র মাহেরের দিকে তাকাল। অনুভব করল, স্বামী এবং বাবাদের অধিকার সবার আগে। সেই সঙ্গে বোনের সুখের কিনারাও খুঁজে পেল৷ গোপনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল,

-” তবে চলুন। ”
.
.
সকালবেলা হৈমী, রুদ্রর মধ্যে কথা কাটাকাটি চলল। বাচ্চাদের আনতে রুদ্র, মাহের আর ছোটো কাকি যাবে৷ হৈমীকে কিছুতেই নিয়ে যাবে না রুদ্র। পেটের সেলাই খোলা হলেও পুরোপুরি সুস্থ নয় হৈমী। তাই তাকে নিয়ে বেরোনোর সাহস পায় না রুদ্র। কিন্তু হৈমী দমবার পাত্রী নয়। সে কেঁদে অস্থির! বাচ্চাদের নিজের কোলে বসিয়ে বাড়ি আসবে। রুদ্র শুরুতে ভালো করে বোঝালেও শেষে চটে গেছে। তার চটে যাওয়ায় হৈমীর কষ্ট বেড়েছে দ্বিগুণ। এমনিতেই বাচ্চাদের থেকে এতদিন দূরে থাকা মেনে নিতে পারেনি৷ তারওপর এই অসুস্থতায় রুদ্র ধমক খেল। বহুদিন পর। সবমিলিয়ে কষ্টরা আকাশ ছুঁয়েছে। হৈমীর কান্না দেখে মায়া হলো রুদ্রর। কী করবে, কীভাবে বোঝাবে? শেষে শান্ত হয়ে বুকে টেনে নিল। আদর পেয়েও জেদ ভাঙল না হৈমীর। রুদ্র চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

-” আচ্ছা যাবে। এরপর যদি কোনো সমস্যা হয় তোমার খবর আছে। রুদ্র সম্পর্কে যদি ধারণা কম থাকে যেতে পারো! ”

ঢোক গিলল হৈমী। দোনোমোনো করে শেষে বলল,

-” যাব না। ”

রুদ্র বিছানা ছাড়তে গিয়ে থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে বলল,

-” সিরিয়াস? ”

থমথমে কণ্ঠে হৈমী বলল,

-” আপনার সন্তানদের আপনিই নিয়ে আসুন। আমার এখন প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ”

তীব্র রাগে চোয়াল ফুলে গেল রুদ্র। এই মেয়ে কেন তাকে বুঝে না? সহসা কাছে এসে দু’গালে চেপে ধরে। ফোঁস ফোঁস করে বলল,

-” আমি তোমাকে জাস্ট বোঝাতে পারি না। ”

ঠিক যেভাবে কাছে এসে গাল চেপে ধরল সেভাবেই আবার সরেও গেল। নিজেকে সম্পূর্ণ তৈরি করে গাড়ি চাবি হাতে নিয়ে মেজাজ দেখিয়ে বলল,

-” রাগ করো, আরো রাগ করো৷ বেশি করে রাগ করো। ”

হৈমী অনড় রইল। রুদ্র এতে আরো ক্ষেপে গেল৷ মৃদু চিৎকার করে বলল,

-” আরো রাগ করো। রেগে আমাকে খু’ন করে দাও। আমি অপরাধী, অপরাধী তো? ওঠলে অপরাধী হবো, বসলে অপরাধী হবো৷ মরণ হয়েছে না আমার মরণ? ”

পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল, রুদ্রর চোখ এমন দেখাল, মুখের কথা এমন শোনালো যে অভিমানের ভীড়েও ঠোঁট টিপে হেসে ফেলল হৈমী। সেটুকু দেখে গটগট পায়ে রুম ত্যাগ করল রুদ্র। শোনা গেল তার উচ্চকণ্ঠে বলা বাক্যগুলো,

-” সূচনা, হৈমীর খাবারটা উপরে পাঠিয়ে দে। ”

এর কয়েক মিনিট পরই রুদ্র হুড়মুড়িয়ে রুমে এলো৷ হৈমী ফোন টিপছিল তখন। রুদ্রকে দেখে চিন্তিত গলায় বলল,

-” কিছু ফেলে গেছেন? ”

রুদ্র মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে বলল,

-” তোমাকেও যেতে হবে। উপায় নেই। ”

চোখ দু’টো চকচক করে ওঠল হৈমীর। খুশিতে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। তখনি ঝটপট রুমে এলো সূচনা। বলল,

-” এই হৈমী রেডি হও। এক কাজ করো তোমাকে যে খিমার বোরখা কিনে দিলাম ওটা পড়ো। এতে সুবিধা হবে। ”

রুদ্র ইতস্ততভাবে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। হৈমী বলল,

-” তোমার ভাই তো নিয়েই যাবে না। কত ঝগড়া হলো। হঠাৎ আবার নিয়ে যাবে যে? ”

-” ইস ভাইয়া কী পাগল! বাবা, মা ছাড়া বাচ্চা দেবে নাকি স্পেশালি মা ছাড়া। ওদের ভালো, মন্দ তো তোমাকেই বুঝিয়ে দেবে। স্পেশাল চাইল্ড না ওরা?
তাছাড়া বাবুরা মায়ের বুকের দুধপান করতে পারছে কিনা এটা দেখাও জরুরি! ”

আঁতকে ওঠল হৈমী। লজ্জায় মরি মরি হয়ে বলল,

-” ছিঃ কী বলো? আমি কিছু দেখাতে পারব না। ”

বোকা বনে গেল সূচনা। মাথায় হাত রেখে বলল,

-” হায় কপাল! আরে গাধী, তুমি সম্পূর্ণ সেভলি বাবুদের খাওয়াতে পারবে৷ ডক্টরদের শুধু প্রবলেম হচ্ছে কি হচ্ছে না তাই জানাবে। ”

নিজের বোকামিতে ভীষণ লজ্জিত হলো হৈমী৷ সূচনা টের পেয়ে বলল,

-” ইস লজ্জা পেতে হবে না। বাচ্চা মেয়ে এরওপর নতুন মা। এসব স্বাভাবিক আমি কিছু মনে করিনি। ”

দরজার বাইরে থেকে সমস্তই শুনল রুদ্র। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। বিব্রতও লাগছে। তবুও রোগ আর ডাক্তার এ দু’টো বিষয়ে লজ্জাদের স্থান দিতে নেই। তবুও হৈমী তো তার বউ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে মহিলা ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শ করার।
_________________________
সব কাজ সেরে সুস্থ ও নিরাপদে বউ বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো রুদ্র। হৈমী আজ ভীষণ খুশি। প্রচণ্ড তৃপ্ত যাকে বলে। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে সে। ছেলেটা রুদ্রর কোলে। মাঝপথে যাওয়ার পরই ছেলেটা কাঁদতে শুরু করল। আত্মা ধক করে ওঠল রুদ্র, হৈমী দুজনেরই! হৈমী চোখ গলেও পানি বেরিয়ে এলো। রুদ্রর দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে বলল,

-” ও কাঁদছে কেন? ”

হতভম্ব হয়ে গেল রুদ্র। হৈমী কী করে বাচ্চাদের সামলাবে? ও নিজেই তো বাচ্চা। এই বাচ্চা কী করে দু দু’টো বাচ্চা সামলাবে? বাচ্চার কান্নায় নিজেই কেঁদে ফেলছে। অথচ তার না কেঁদে বাচ্চাদের সমস্যা বোঝা উচিৎ ছিল এবং সমাধানের চেষ্টা করা উচিৎ ছিল। রুদ্রর চিন্তিত মুখে তাকিয়ে ছোটো কাকি বলল,

-” এই ওর বোধহয় খিদে পেয়েছে। ছোটো বাচ্চা তো ঘনঘন খেতে দিতে হয়। দেখি আমার কাছে দাও। ”

কাকির কথা শুনে রুদ্র ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থামালে ড্রাইভার সহ মাহেরও বেরিয়ে গেল। কাছেই এক দোকানে চা খেতে বসল ওরা। রুদ্র ছেলেকে ছোটো কাকির কাছে দিয়ে ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিল। ছোটো কাকি পজিশন ঠিক করে হৈমীকে সাহায্য করল। রুদ্র তখন নড়াচড়া করা বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সহসা মেয়েটাও কেঁদে ওঠল৷ ডক্টর বলেছে মেয়েটা অত্যাধিক দুর্বল। জন্মানোর পর সে অনেক পরে রেসপন্স করেছে। এখনো সবকিছুতেই কম প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেহেতু তার জমজ বাচ্চা সেহেতু খেয়াল রাখতে হবে দুদিক সমান রেখে। মেয়েটা যখন কেঁদে ওঠল তখন রুদ্রর বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল। হৈমীও ঘাড় ফিরিয়ে ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে। ছোটো কাকি বলল,

-” ওরও বোধহয় খিদে পেয়েছে। এমন হয় জমজদের৷ একজন কাঁদলে আরেকজ কাঁদে। একজনের জ্বর হলে অপরজনেরও জ্বর আসে। খিদের বেলাও মনে হয় তাই। সর্বনাশ হয়েছে গো হৈমী। তুমি সামলাবে কী করে! ”

রুদ্রর মেজাজ খারাপ করল। কোথায় সাহস দেবে তা না ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। সে নিজেই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে। তাহলে হৈমীর মনের অবস্থা কী! কেশে ওঠল রুদ্র। মেয়েটাকে থামাবে কী করে? করুণ চোখে তাকাল হৈমীর দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলল,

-” ওর হয়েছে? ”

হৈমী কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,

-” বুঝতে পারছি না। ”

ছোটো কাকি বলল,

-” রুদ্র ওকে আমার কাছে দাও। ”

পরিস্থিতি দেখে হাসফাস লাগল রুদ্রর। ছোটো কাকির সামনে ইতস্ততও লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই। বাচ্চাদের সুবিধা আগে দেখতে হবে। সব লজ্জা, বিব্রতবোধ একপাশে রেখে কেবল বাচ্চাদেরই প্রাধান্য দিল রুদ্র, হৈমী। তারা যে নতুন বাবা, মা। সবকিছুতেই বড্ড কাঁচা। তাই ছোটো কাকির সামনে এ মুহুর্তে লজ্জা পাওয়া মানে বাচ্চাদেরই ক্ষতি! বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাচ্চারা আবার কান্না শুরু করল। এর মানে আবার খিদে পেয়েছে ওদের৷ রুদ্র, হৈমী দুজনেই হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে কারো সঙ্গে ভালো, মন্দ কথা না বলেই বাচ্চাদের নিয়ে উপরে চলে গেল। হৈমীকে সাপোর্ট দিল ছোটো কাকি। সূচনা ছুটে এলো, এলো হামিদাও। রুদ্র যেন ভরসা পেল। হামিদা হৈমীর মা আর সূচনা তার নিজের বোন৷ এই দু’জন মানুষের কাছে বাচ্চা সহ হৈমীকে ছেড়ে দেয়া যায় নিশ্চিন্তে। দিনটা তারাই সামলাক। রাতটা সে আর হৈমী সামলে নেবে। ভেবেই রুদ্র সূচনার কোলে মেয়েকে দিয়ে বলল,

-” ওদের একসঙ্গে খিদে পায়রে। হৈমীকে সাহায্য কর। ও সামলাতে হিমশিম খায়। ”

ভাইয়ের করুণ স্বরে আচমকা হেসে ফেলল সূচনা। বলল,

-” আরে ভাইয়া তুমি চিন্তা করো না। নতুন নতুন এমন হয়ই। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

-” দু’জনকে ও সামলাবে কী করে রে? এখন আমি ফ্রি আছি। সব সময় তো থাকব না৷ গোটা বিজনেস পড়ে আছে। বাবা কতদিন দেখবে আর? ”

-” উফফ ভাইয়া টেনশন নিচ্ছ কেন? হৈমীর ওপর ভরসা রাখো। সবশেষে ও কিন্তু ওদের মা। আর মায়েরা সব পারে সব। দু’জন কেন? পাঁচজন হলেও ঠিক সামলে নেয়। তুমি অযথা টেনশন করছ। ”

.
.
সময় গড়াতে গড়াতে রাত নামল। ডিনার সেরে বসার ঘরে সবাই মিলে আলোচনায় বসল। বিষয় বাচ্চাদের নাম কে রাখবে? কী রাখবে? হৈমী তখন নিজের ঘরে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে মেয়েটাকে বুকে আর পাশেই হাতের কাছে ছেলেকে শুইয়েছে। হামিদা বসে নাতি, নাতনিকে মুগ্ধ চোখে দেখছে। আর মেয়েকে বোঝাচ্ছে কীভাবে কী করবে। এমন সময় রুদ্র ঘরে এলো। শাশুড়ির সামনেই বউকে জিজ্ঞেস করল,

-” ওদের নাম কী রাখবে? ”

হৈমী রুদ্রর দিকে ক্লান্ত চোখে তাকাল। বলল,

-” আপনি রাখুন। আমার মাথা কাজ করছে না। ”

হামিদা মুচকি মুচকি হাসল। বলল,

-” তুমিই রাখো বাবা। মেয়েটা একেবারে দুই সন্তানের জননী হয়ে দিশেহারা। ”

হৈমী মায়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। হামিদা বলল,

-” একা জ্বালিয়েছিস এবার দেখ দু’টো কেমন জ্বালায়। ”

রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলল হৈমী। বলল,

-” জ্বালাক তবুও ওরা সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকুক আম্মু। আমি ওদের খুব আদর করব খুব ভালোবাসব। ”

হামিদা মেয়ের কথা শুনে অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশিও হলেন। মনে মনে বললেন,

-” আল্লাহ আমার মেয়েটাকে বোঝদার করুক। সুখী করুক। ”

ঘর ছেড়ে ফিরে আসার পর চাচাত ভাইরা রুদ্রকে জিজ্ঞেস করল,

-” ভাবি কী নাম বলল? ”

-” আমায় রাখতে বলেছে। ”

মাহের বলল,

-” আপনিই রাখুন। ”

রুদ্র চুপচাপ গিয়ে বসল সূচনার পাশে। দীর্ঘক্ষণ ভেবেচিন্তে বলল,

-” আমাদের ছেলে রুদ্রিক শেখ। আর মেয়ে রুদবা শেখ। রুদ্র এণ্ড হৈমী’স সন এণ্ড ডটার রুদ্রিক, রুদবা। ”

চলবে…

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here