বেদনার_রঙ_নীল সাতচল্লিশতম পর্ব

0
233

#বেদনার_রঙ_নীল
সাতচল্লিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

সন্ধ্যার মধ্যেই তাবু টানিয়ে শুয়ে পড়েছে সবাই। ভোরের আগে উঠে ট্র্যাকিংয়ে যেতে হবে৷ রিসবের চোখে ঘুম নেই। তাবুর বাইরে ক্যাম্প-ফায়ারের সামনে বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছে সে। হিমশীতল বাতাসে পরিবেশ ছেয়ে আছে। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে ঝি ঝি পোকার ডাক। রিসবের বিষণ্ণ মন আরও বিষণ্ণ লাগে। নিঃশ্বাস আটকে আসার মতো কিছু একটা বিঁধে আছে বুকে। অন্ধকার নীলচে আকাশের দিকে চাইতেই ভেসে উঠে স্নিগ্ধ মুখ। মিষ্টি কণ্ঠ অবিরত প্রশ্ন করে,” কবে ফিরবেন? প্লিজ বলে যান। আপনি খুব রুড।”

আজকে রিসবের একটু বেশিই মনে পড়ছে রাইফার কথা। সামনের মাসেই সে চলে যাবে এই দেশ ছেড়ে। এতোদিন তার স্বপ্ন ছিল শুধুই এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করা। কিন্তু এখন আরও একটা নতুন স্বপ্ন যোগ হয়েছে। তার নতুন স্বপ্নের নাম রাইফা। এই স্বপ্ন তাকে ক্রমশ পুরনো স্বপ্নের প্রতি ভীত করে তুলছে। আচ্ছা, এভারেস্টজয় করতে গিয়ে যদি তার কিছু হয়, তাহলে রাইফার কি হবে? আজ এসব অহেতুক চিন্তা মাথায় বেশি আসছে কারণ গতকাল রিসবের পরিচিত এক সহচর পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেছে। এতো দক্ষ আর সাহসী আরোহী ছিল, তবুও নিয়তির নিষ্ঠুরতার কাছে তাকে হার মানতেই হলো। রিসবের এতোদিন নিজের জীবন নিয়ে পরোয়া ছিল না। কিন্তু এখন তার পরোয়া আছে। এখন তার রাইফাও আছে। রিসবের মনটা অকারণে খুব অস্থির হয়ে উঠছে! রাইফার সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কেমন আছে সে? তাকে একটা চিঠি লিখলে কেমন হয়? এই পাহাড়ী এলাকায় নেটওয়ার্ক নেই। থাকলে রিসব ম্যাসেজ পাঠাতো। সেটা এখন সম্ভব নয় বলেই তার মাথায় চিঠির চিন্তা এসেছে। সে ব্যাগ থেকে কাগজ আর কলম বের করে লিখতে বসল।

রাইফা,
জানো কি হয়েছে? আমার এক বন্ধু কাল পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেছে। এজন্য মনটা খুব খারাপ।

এইটুকু লিখেই থেমে গেল রিসব। আর কি লিখবে? কিছুই মাথা আসছে না। তার রাইফাকে দেখতেও খুব ইচ্ছে করছে। ঘড়িতে এখন সন্ধ্যা ছয়টা বাজে৷ রিসব যদি এই মুহূর্তে রওনা হয় তাহলে ঢাকায় পৌছাতে তার কত সময় লাগবে?

________
প্রণয়ের ঘুম ভাঙল রাত দশটায়। দেয়াল ঘড়িতে নজর যেতেই সে তড়াক করে উঠে বসল। এটা কোথায় আছে সে? একটু পরেই মনে পড়ল, প্রিয়ন্তীর বাড়িতে এসেছিল। এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কি সর্বনাশ! হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠতে নিতেই বিছানার সাথে লাগোয়া ফ্লাওয়ার হ্যাঙ্গারটা পড়ে গেল। জোরে শব্দ হওয়ায় প্রিয়ন্তী ছুটে এলো।

প্রণয় জিনিসটি তুলে আবার জায়গামতো রেখে দিচ্ছিল। প্রিয়ন্তী মৃদু হেসে বলল,” উঠেছিস? আচ্ছা তাহলে তুই ফ্রেশ হয়ে আয়৷ আমি খিচুরী রান্না করেছি। তোর তো ফেভারিট।”

প্রণয় রাগী কণ্ঠে বলল,” এতোরাত হয়ে গেছে। তুই আমাকে ডাকলি না কেন?”

প্রিয়ন্তী অপ্রস্তুত হাসল। ইতি-উতি করে বলল,” ডাকবো কেন? তুই আরাম করে ঘুমাচ্ছিলি তাই আমিও ভাবলাম থাক।”

” আমি যে কিভাবে ঘুমিয়ে পড়লাম সেটাই মাথায় আসছে না। এমন মরার মতো ঘুম কখনও হয়নি আমার।”

” আচ্ছা বাদ দে। ঘুমিয়েছিস ভালো করেছিস। এখন খেতে চল।”

” আমি খাবো না। বাসায় যেতে হবে। অনেক লেইট হয়ে গেছে এমনিতেও।”

প্রণয় দরজার কাছে গিয়ে জুতো পরতে লাগল। প্রিয়ন্তী তার কাছে এসে গোমরা মুখে বলল,” কষ্ট করে রান্না করেছি। আর তুই না খেয়েই চলে যাবি?”

” আমি তো তোকে রান্না করতে বলিনি। তুই করেছিস কেন?”

প্রিয়ন্তী প্রণয়ের হাত চেপে ধরল। প্রণয় বড় বড় চোখে তাকাতেই সে কোমল গলায় বলল,” তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস প্রণয়?”

প্রণয় হাত ছাড়িয়ে বলল,” না। কিন্তু বিরক্ত হয়েছি। তোর আমাকে ডাকা উচিৎ ছিল। যদি আমার ঘুম না ভাঙতো তাহলে হয়তো সারা রাত আমি এখানেই থাকতাম।”

প্রিয়ন্তী ‘যেন কিছুই হয়নি’ এমনভাবে হেসে বলল,” তো কি হয়েছে থাকলে?”

প্রণয় ভ্রু কুচকে তাকিয়ে দরজা খুলতে নিচ্ছিল। প্রিয়ন্তী ডাকল,” শোন।”

প্রণয় থামল। প্রিয়ন্তীকে আচমকা কেমন আনমনা দেখাচ্ছে। সে ঘোর মেশানো কণ্ঠে বলল, ” যদি আমি প্রিয়ন্তী দাস না হতাম তাহলেও কি আমাদের সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বেই সীমাবদ্ধ থাকতো?”

” মানে?”

” মানে আমি যদি হিন্দু না হয়ে মুসলিম হতাম তাহলেও কি তুই শুধু আমার বন্ধুই থাকতি?”

প্রণয় খুব বিস্মিত হলো। সরু গলায় বলল,” হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”

” আগে উত্তরটা দে। ”

” আমি জানি না।”

প্রিয়ন্তী মুচকি হাসল। প্রণয় কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রিয়ন্তী হঠাৎ এই প্রসঙ্গে কেন কথা বলছে তা বুঝতে পারছে না সে। তারপর খুব হঠাৎ করেই প্রিয়ন্তী কাছে এসে তার গালে চুমু দিল। প্রণয় হতভম্ব হয়ে গেল। দরাজ গলায় বলে উঠল,” হোয়াট দ্যা হেল ইজ দিস?”

প্রিয়ন্তীর যেন সম্বিৎ ফিরল। সচকিত হয়েই করুণ গলায় বলল,” আই এম স্যরি।”

” তুই পাগল হয়ে গেছিস। আমার তোর এখানে আসাটাই উচিৎ হয়নি।”

প্রণয় হনহন করে বের হয়ে গেল। প্রিয়ন্তী অনেকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। তার কান্না পাচ্ছে। অন্যসময় সে দরজা আটকে কাঁদে। আজ দরজা খুলেই কাঁদছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে দুয়েকজন তাকে দেখল। দেখুক, আজ সবাই তার কান্না দেখুক। প্রিয়ন্তী সবাইকে জানাতে চায়, সে ভালো নেই। একটুও ভালো নেই।

গেইটের সামনেই প্রণয়ের গাড়িটা ছিল। সেই গাড়ির পাশেই একটা ট্যাক্সি দাঁড়ানো। সেই ট্যাক্সির ভেতরে বসে আছে তুলি। প্রণয় তুলিকে দেখে অনেকটা ভূত দেখার মতোই চমকে উঠল। কয়েক মুহূর্ত কোনো কথাই বলতে পারল না৷ তার মাথায় প্রশ্ন ঘুরছে। তুলি কিভাবে জানল যে সে এই বাড়িতে আছে?

তুলি ট্যাক্সি থেকে নেমে প্রণয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। হাত ভাঁজ করে বলল,” ভয় পেয়েছেন?”

প্রণয়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” না। ভয় কেন পাবো?”

” সেটাই তো। ভয় কেন পাবেন? আপনি কি এমন করেছেন? শুধু বান্ধবীর বাড়িতে ঘুমাতে এসেছিলেন। এটা তো ভয় পাওয়ার মতো এমন কোনো বড় অপরাধ নয়। তাই না?”

প্রণয় যথেষ্ট বিব্রতবোধ করল। নিজেকে স্বাভাভিক রেখে বলল,” তুমি এখানে কি করছো?”

” আপনাকে নিতে এসেছিলাম। ভাবলাম বাড়ির কথা হয়তো ভুলেই গেছেন।”

প্রণয় তুলিকে বোঝানোর চেষ্টা করল,” দেখো তুলি, ডন্ট মিস আন্ডারস্ট্যান্ড। আমি টায়ার্ড ছিলাম তাই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও টের পাইনি। আর যখনি আমার ঘুম ভেঙেছে আমি তখনি বের হয়ে এসেছি। এতো দেরি হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারিনি।”

প্রণয়ের কথার মাঝেই তুলি ব্যাগ থেকে টিস্যুপেপার বের করে তার সামনে ধরল। জড়ানো কণ্ঠে বলল,” আপনার গালে লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে। সেটা মুছুন আগে।”

প্রণয় হকচকিয়ে গেল। গালে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করল যে সত্যি লিপস্টিকের দাগ আছে নাকি। অবশ্য থাকতেও পারে। তুলির চোখ ছলছল করছে। সেই চোখে একরাশ অবিশ্বাস, বিতৃষ্ণা। প্রণয় বুঝতে পারল সে এখন মাথা ঠুঁকে মরে গেলেও তুলি আর তার কথা বিশ্বাস করবে না। অসহায়ের মতো তাকালো সে। তীব্র অনুনয় করে বলল,” তুলি, প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করো। আমি কিছুই করিনি।”

তুলি নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলল,” বাকি কথা বাসায় গিয়ে হবে। এখন চলুন।”

প্রণয়ের হাতে টিস্যুর টুকরোটা ধরিয়ে ট্যাক্সির দিকে এগিয়ে গেল তুলি। প্রণয় তার পেছনে এসে জিজ্ঞেস করল,” ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?”

তুলি না তাকিয়েই উত্তর দিল,” আমরা আলাদা যাবো। আপনি গাড়িতে যান। আমি ট্যাক্সিতে আসছি।”

তারপর আর এক মুহূর্ত দেরী না করেই ট্যাক্সিতে চড়ে বসল। প্রণয় দাঁড়িয়ে দেখল কেবল। কিছুই বলতে পারল না। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বুক ভারী লাগছে। রাগে গাড়ির হেডলাইট বরাবর একটা লাথি মারতেই সেটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল।

_________
ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে দরজায়। এতো রাতে কে আসবে? লুকিং গ্লাসে তাকিয়েই চমকে উঠল রাইফা। বিস্ময়ে মুখের কাছে হাত চলে এলো। অন্যসময় হলে সে বিকট চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতো। কিন্তু এতো রাতে তো আর চেঁচানো যায় না। মায়ের ঘুম ভাঙলে সর্বনাশ। রাইফা দরজা খুলেই ফিসফিস করে বলল,” আপনি? এটা কি সত্যিই আপনি? আমার না একদম বিশ্বাস হচ্ছে না!”

রিসব তৃষ্ণার্তের মতো রাইফার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মৃদু হেসে বলল,” আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না।”

রাইফার চোখমুখ ঝলমল করছে। রিসব একটু কাছে এলো। বলল,” ভেতরে ঢুকতে বলবে না? সেই বান্দরবান থেকে এসেছি।”

রাইফা বিমুগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” আমার জন্য এসেছেন?”

” না। আমার জন্য এসেছি। তোমাকে না দেখে আমি থাকতেই পারছিলাম না যে! সেজন্য।”

রাইফা প্রায় কেঁদেই ফেলল। তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে গড়াতে লাগল অশ্রু। একহাতে মুখ ঢেকে আবারও একই কথা বলল,” আমার এখনও কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না। এটা কি স্বপ্ন?”

রিসব যেন প্রমাণ দিতেই রাইফাকে ছুঁয়ে দিল। তার গালে হাত রেখে মুখটা সামান্য উঁচু করে বলল,” অবুঝ মেয়ে, চলো বিয়ে করে ফেলি।”

রাইফা এবার চূড়ান্ত বিস্ময়ে হাত-পা ছেড়ে একদম মেঝেতে বসে পড়ল। পেছনে জুতোর স্ট্যান্ড ছিল। স্ট্যান্ডের সাথে ধাক্কা লেগে জোরে শব্দ হয়। ভেতরের ঘর থেকে সূচি ডাকলেন,” রাইফা, কে এসেছে?”

রাইফা তড়াক করে উঠে রিসবকে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। মা যে কোনো সময় ঘর থেকে বের হতে পারেন। তড়িঘড়ি করে দরজা আটকেই রিসবকে পর্দার পেছনে লুকাতে চাইল রাইফা। অন্ধকারে হয়তো সূচি দেখবেন না। ঠিক তখনি ড্রয়িংরুমে এসে বাতি জ্বাললেন সূচি। রাইফা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। সূচি আশেপাশে তাকিয়ে বললেন,” কে এসেছিল?”

” কই?”

” আরে, দরজা খোলার আওয়াজ শুনলাম তো। ঘুমটাই ভেঙে গেল আমার।”

” স্বপ্ন দেখেছো মনে হয়।”

সূচি সন্দেহ করলেন। রাইফার বাচনভঙ্গি অস্বাভাবিক। গলার স্বর কাঁপছে। তিনি ফিরে যেতে নিলেই হঠাৎ খেয়াল করলেন ড্রয়িংরুমের পর্দাটা ফেঁপে আছে। নিচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে একজোড়া পা। বিস্ময়ে সূচি চিৎকার দিলেন,” ওখানে কে লুকিয়ে আছে রাইফা?”

রাইফার চোখমুখ শুকিয়ে গেল। রিসব যখন বুঝল সে অগত্যা ধরা পড়ে গেছে তখন পর্দার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এলো। মাথা নত করে বলল,” স্যরি আন্টি। আমি এসেছিলাম।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here