“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮
(নূর নাফিসা)
.
.
আরাফকে সাথে নিয়ে নাজিয়ার বাবা-মা জহিরুল ইসলামের বাড়িতে এসেছেন। ঘুরেফিরে দেখলেন, ছেলের মা বাবা ও বড় বোনের সাথে কথাবার্তা বললেন। পছন্দ হয়েছে বাড়ির মানুষজন। ছেলেটা বেশি একটা কথা বললো না তাদের সাথে। তাদের ধারণা অপরিচিত বলে কথা বলতে একটু বিব্রত বোধ করছে। সবশেষে জহিরুল ইসলাম নিয়াজ উদ্দিনকে বাধ্য করলেন মেয়ের বিয়ে নির্ধারণ করতে। আরাফও মত পোষণ করলো। এই মাসে নাহিদার পরীক্ষা তাই নিয়াজ উদ্দিন পরীক্ষার পর বিয়ের দিন পাকা করতে বললেন। জহিরুল ইসলামও রাজি হলেন। কিন্তু এনগেজমেন্ট আগেই করা হবে।
.
সকাল থেকেই নাফিসার পেট ব্যাথা করছিলো। কেননা গত রাতে মা বেগুনি আর পিয়াজু বানিয়ে ছিলো বোল ভরে আর নাফিসা খেয়েছে পেট ভরে! অবশ্য তার কথায়ই বানিয়েছে। সপ্তাহ না ফুরাতেই নাকি তার বছর ফুরিয়ে যায় এটা খায় না, ওটা বানিয়ে দেয় না! তাই রোমানা কাল বানিয়ে দিয়েছে ইচ্ছেমতো খাওয়ার জন্য! এই পেট ব্যাথার জন্য আজ ভার্সিটি যায়নি।
দুপুরে নাহিদা বাড়ি ফিরে কাউকে দেখতে না পেয়ে ডাকলো,
– নাফিসা?
নাফিসা বাথরুম থেকে জবাব দিলো,
– কি?
– কোথায় তুই! বাথরুমে কি করছ!
– বাথরুমে কি করে তুমি জানো না!
– খাটাশ! বাথরুমে থেকে আবার কথা বলে কেউ!
– বাথরুমে আছি, জেনেও তো তুমি বকবক শুরু করছো!
নাহিদা হাসতে হাসতে ঘরে চলে গেলো। নাফিসা ঘরে এলে নাহিদা বললো,
– পেট ব্যাথা কমেছে?
– একটু।
– সেলাইনের প্যাকেট শেষ?
– অর্ধেক।
নাহিদা খিলখিল শব্দ করে হেসে বললো,
– খাও বাপু! শুধু পেট কেন! গলা পর্যন্ত ভরে আরও বেশি বেশি খাও বেগুনি আর পিয়াজু! চিন্তা করো না, গিফট স্বরূপ পরের একসপ্তাহ তোমার জন্য এক বক্স সেলাইন নিয়ে আমি হাজির থাকবো!
– মজা নেও! সময় আমারও আসবে! হুহ্!
– মা কোথায়?
– তোমার শ্বশুর বাড়ি।
– ফাজলামো না, সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি।
– আমিও তো সিরিয়াসলিই উত্তর দিচ্ছি!
– আমার আবার শ্বশুর বাড়ি আসলো কোথা থেকে!
– কেন, ওইদিন না তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি এসে দেখে গেলো তোমাকে! উনাদের কি বাড়ি নেই নাকি! আল্লাহ! আপুউউউ…তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন গাছ তলা থাকে! আমাদের বাড়িতে জায়গা আছে চলে আসতে বলো।
– লাথি খাবি একটা! যা, ভাগ!
নাফিসা হিহিহি করে হাসতে লাগলো। নাহিদা ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসলো।
বিকেলে নিয়াজ উদ্দিন ও রুমানা বেগম বাড়ি ফিরে এলো। আরাফ তাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। তার কাজ আছে তাই।
সন্ধ্যায় পড়তে বসলে নাহিদার মা রুমানা এসে নাহিদার কাছে বিয়ের ব্যাপারে সব পরিষ্কার বলে মতামত চাইলো। বিয়েতে সে রাজি আছে কি-না! ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নাহিদার উত্তর এলো, উনারা বাবা-মা যা ভালো মনে করবেন তাতেই নাহিদা রাজি। তার বাবা তার প্রত্যক্ষ জবাব চাইলে সে তার বাবাকে উল্টো প্রশ্ন করলো, “বাবা তোমার পছন্দ হয়েছে?” নিয়াজ উদ্দিন “হ্যাঁ” জবাব দিতেই নাহিদার জবাব হ্যাঁ হয়ে গেলো।
দুদিন পরেই নাহিদার এনগেজমেন্ট। নাহিদার পরীক্ষার জন্য কার্যক্রম এতো তারাতাড়ি করা হলো।নাজিয়াকে আসতে বলা হলো, কিন্তু ওদিকে এমন অবস্থা ফেলে তার আসা সম্ভব হলো না! অবশ্য বাবা-মাকে জানায়নি সেটা। অন্যান্য ব্যস্ততার অযুহাতে বাবা-মাকে মানিয়ে নিলো। যদি সম্ভব হয়, আরাফ আসবে।
আজ নাহিদা নাফিসা কেউই ভার্সিটি যায়নি। সকাল থেকেই মায়ের সাথে কাজে হাত লাগিয়েছে। বিকেলে ওবাড়ি থেকে মেহমান এলো। পাশের বাড়ির চাচাতো বোন আর নাফিসা মিলে নাহিদাকে সাজিয়ে তৈরি করলো। খাওয়াদাওয়ার শেষে নাহিদাকে নিয়ে যাওয়া হলো মেহমানদের সামনে। মেহমান বলতে বসে আছে ছেলেসহ তার বাবা, মা, বোন, দুলাভাই আর চাচা চাচী। সালাম দেওয়ার পর সবার চেহারা ছাড়িয়ে চোখ আটকে গেলো ছেলেটার উপর! এই ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! এটা তো একটা ভন্ড! বাবা-মায়ের সাথেই চিটিং করে! নাহিদার রিয়েকশন এখন কেমন হওয়া উচিত সে নিজেই বুঝতে পারছে না! এই ছেলেকে এতো ভালো লেগেছে বাবা মায়ের! অবশ্য বাহ্যিক দিক থেকে দেখতে অনেক ভালো! হয়তো সেই ভালোটাই দেখেছে তার বাবা-মা। এজন্যই তো সেদিন এই আংকেল আন্টিকে খুব চেনা চেনা লাগছিলো! কিন্তু মাথায় ধরছিলো না তাদের ফোনে, ভিডিও কলে দেখেছে!
এমন হাজারো কথা ঘুরপাক খাচ্ছে নাহিদার মাথায়! আজ তার এনগেজমেন্ট হওয়ায় সে আতঙ্কিত, বাকিরা উৎফুল্ল আর মেহেদী নামক ছেলেটা গম্ভীর! মাঝে মাঝে তার বাবার ধাক্কায় সে নাহিদার বাবামায়ের সাথে জোরপূর্বক হেসে কথা বলছে! নাহিদার দিকে তেমন তাকাচ্ছেও না! একটু আধটু দৃষ্টি পড়লেও যেন সেটা বিরক্তিকর দৃষ্টি!
অবশেষে মেহেদীর সাথেই হলো এনগেজড, মেহেদীর হাতেই পড়তে হলো রিং! ভেতরটা ধুকপুক শব্দ করছে নাহিদার। চোখে পানি এসে ভীড় জমাচ্ছে আর সেটা জমাট বেঁধে গড়িয়ে পড়ার আগেই সে টিস্যু দিয়ে মুছে নিচ্ছে! এতো খারাপ লাগছে কেন তার! মনে হচ্ছে পরিবার ছেড়ে যেন চিরজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে! নাহ, এখন তো মাত্র আংটি পড়ানো হলো। সে তো নিজেদের বাড়িতেই আছে! আর বিয়ে হলেই কি, চিরজীবন কি তার পরিবার থেকে দূরে থাকবে! সে যখন ইচ্ছে তখনই চলে আসবে।
নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিচ্ছে, তবুও মন শান্ত হচ্ছে না!
সুষ্ঠুভাবে কার্যক্রম সম্পাদিত হলো। গুরুজন নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করার সময় মেহেদীর বড় বোন মেহতাজ নাহিদার সাথে আলাদাভাবে পরিচিত হলো, তার হাসবেন্ড আসিফের সাথে এবং ছয় ও দু বছরের বাচ্চা আয়াশ ও আরিশার সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলো।
অত:পর মেহেদীকে নাহিদার সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিলো মেহতাজ। কিন্তু মেহেদী কিছুই বললো না! আর নাহিদা তো এমনিতেই নির্বাক হয়ে আছে!
সন্ধ্যার পরপরই তারা চলে গেলো। নাহিদার মনে সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়াবহ অনুভূতির! কখনো বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছে আবার কখনো বা আকুল আবেদন বিশিষ্ট আবেগ! যেন বিনা সংকেতে এক ঝড় এসে সুসংবাদ দিয়ে গেলো! ভাবনার বাইরে ছিলো সময়টা এতো তারাতাড়ি চলে আসবে! তাও আবার এই মানুষটা আসবে তার মনের গহীনে থাকা রাজার আসন দখল করতে! প্রথম দেখার কথা মনে হতেই নাহিদা ওয়ারড্রব খুলে দোপাট্টাটা বের করলো। তার ঠোঁটের কোনায় সাথে সাথেই ফুটে উঠেছে প্রাণান্ত হাসির ঝিলিক! সে দোপাট্টা মাথায় দিয়ে আয়নার সামনে এসে দাড়ালো। পুরো বউ বউ লাগছে! ভেবেছিলো মেহেদীর সাথে দেখা হলে দোপাট্টাটা ফিরিয়ে দিবে। কিন্তু তা আর হলো না! ভাবতেই অবাক লাগছে এই দোপাট্টার অধিকারিণী অতি শীঘ্রই সে-ই হতে যাচ্ছে! তাহলে শুরু থেকে শেষটা তারই রয়ে যাবে! এটা মোটেও অভিনয় না, এটা সত্যি সত্যিই ঘটতে চলেছে। তার উপযুক্ত প্রমাণ তো নাহিদার হাতের রিং টা-ই দিয়ে যাচ্ছে!
.
পেছন থেকে নাফিসা এসে “ভাও” শব্দ করে উঠতেই নাহিদা ভয় পেয়ে গেছে! নাফিসার হাতে একটা মেরে নাহিদা বললো,
– স্টুপিড! এভাবে ভয় দেখানোর কি আছে?
নাফিসা হিহি করে হাসতে হাসতে বললো,
– এইটুকুতে ভয় পাওয়ার কি আছে! ওমা! এই দোপাট্টা কোথায় পেলে!
নাহিদা তারাতাড়ি দোপাট্টা খুলে মুড়িয়ে নিতেই নাফিসা হুট করে নিয়ে নিলো।
– নাফিসা, দে এইটা।
– আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। কার এইটা?
– কার আবার! আমার।
– তুমি আবার দোপাট্টা কিনলে কবে?
– তোকে বলতে হবে!
– হু, না বললে পাবে না। দাড়াও মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে আসি।
– এই দাড়া দাড়া! মায়ের কাছে যাবি না। আমিই বলছি, এটা গিফট দিয়েছে একজন।
– ওমা! তাই নাকি! লাল দোপাট্টা…. হই হই, লাল দোপাট্টা, উড়গায়া…
নাফিসা দোপাট্টা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে গান ধরলো কিন্তু গানটা আর গাইতে দিলো না নাহিদা! দোপাট্টা ছিনিয়ে নিতে এসেছে আর নাফিসা তা নিয়ে দৌড়ে খাটে উঠে গেছে। খাটের উপর দাড়িয়ে হাসতে হাসতে বললো,
– কে দিয়েছে?
– কে আবার দিবে! যার দেওয়ার কথা সে-ই দিয়েছে।
কথাটা বলেই নাহিদা খাটে উঠে হেচকা টান দিয়ে হাত থেকে দোপাট্টা নিয়ে ওয়ারড্রবের কাছে গেলো। নাফিসা পিছু পিছু হাটতে হাটতে বললো,
– যার দেওয়ার কথা মানে! কার দেওয়ার কথা!
– আমি বলবো কেন! এতো বুদ্ধির জাহাজী তুই, তাহলে খুজে বের কর।
– তুমি কি বলতে চাইছো তোমার মিস্টার হবু দিয়েছে?
নাহিদা ওয়ারড্রবের ড্রয়ার লাগিয়ে মুচকি হেসে পড়ার টেবিলের দিকে যেতে যেতে বললো,
– জাহাজী না হলেও একটু বুদ্ধি আছে তোর মাথায়! যা আমি স্বীকার করলাম!
নাফিসা উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– আপু, তোমাদের তো আজ প্রথম দেখা হলো! প্রথম দিনেই দোপাট্টা গিফট করেছে!
– হু, প্রথম দিনেই দোপাট্টা গিফট করেছে।
– কখন দিলো! আমি দেখলাম না কেন!
নাহিদা মুখে ভয়ার্ত ভাব এনে ফিসফিস করে বললো,
– লুকিয়ে লুকিয়ে দিয়েছে, তুই দেখবি কি করে! তুই দেখলে কি আর সেটা লুকানো যেতো!
নাফিসা একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। তা দেখে নাহিদা খিলখিল শব্দ করে হেসে উঠলো! অত:পর নিজের পড়াশোনায় মনযোগ দিলো। নাফিসাও বিশ্বাস করে নিলো নাহিদার কথা এবং নিজেও পড়তে বসলো।