#Mr_Husband,পর্ব_৭,৮
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৭
মুন ওলি’র সাথে খেলছে আর দুষ্টুমি করছে। আবার খিলখিল করে দুজনেই হেসে উঠছে। মুনের বাচ্চা ছেলে মেয়ে খুব পছন্দ। কিন্তু মেয়েদের খুব বেশি পছন্দ করে। মুন আঁধারের কেবিনে একা বসে থাকলে ভোর হবে। তাই আঁধার মুন কে এখানে রেখে সার্জারির জন্য চলে গেছে। মুন আঁধারের নতুন নাম ও রেখেছে ‘মিস্টার হার্ট সার্জেন্ট’। আঁধার নামটা শুনে অনেক অবাক হয়েছিল। আঁধার যাওয়ার আগে মুন কে বলে গেছে এখান থেকে কোথাও যেন এক পা ও না নড়ে। মুন তখন লক্ষি মেয়েদের মতো মাথা নাড়লেও তার পক্ষে আর এখানে বসে থাকা সম্ভব না। কারণ ওলি খেলতে খেলতেই ঘুমিয়ে গেছে। এখন সে একা এখানে বসে কি করবে? তাই মুন আস্তে পা টিপে টিপে বেরিয়ে যায়। কিন্তু মুন এখানের কিছুই চিনে না। তার উপর এতো বড় হসপিটাল। আঁধার কোন ফ্লোরে আছে মুন তাও জানে না। যদি একা একা হারিয়ে যায়? এসব চিন্তা করতে করতে মুন আনমনে হাঁটছিলো। আচমকা কেউ মুনের সামনে এসে ভাউ করে উঠতেই মুন জোরে চিৎকার করে উঠলো। তার রুহু যেন ভয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বুকের ভিতর মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। মুনের দু’চোখ বন্ধ। কারেন্টে ধরলে মানুষ যেভাবে কাপে মুন ও ঠিক সেই ভাবেই কাঁপছে। হঠাৎ জোরে জোরে হাসির শব্দ মুনের কানে ভেসে এলো। মুন পিটপিট করে এক চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দেখে একটা সুদর্শন যুবক তার সামনে দাঁড়িয়ে শরীর দুলিয়ে হাসছে যেন সে কোনো ফানি ভিডিও দেখছে। মুন শিওর ওকে ভয় দেখানো এই লোকটার’ই কাজ। ছেলেটার হাসি মুনের কাটা ঘায়ে যেন নুনের ছিটে রং মতো লাগছে। মুন রেগে বলল,
—“অসভ্য, অভদ্র, ইডিয়েট, ইস্টুপিড, গাধা কোথাকার। কোনো কমন সেন্স নেই? এভাবে কেউ ভয় দেখায়?”
মুনের কথা শুনে লোকটা আরো জোরে জোরে হাসতে শুরু করলো। মুনের গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ঠাঁটিয়ে দুটো চড় দিতে। মুন চলে যেতে নেয় এমন সময় লোকটার গা জ্বালানো কথা শুনে থেমে যায়। লোকটা অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললো,
—“তো কিভাবে ভয় দেখায় মিস ভীতুর ডিম।”
কথা টা বলেই লোকটা চোখ টিপ মারল। মুন পুরো রেগে আগুন। মুন থাপ্পড় মারতে যাবে তার আগেই ছেলেটা ক্যাবলাকান্ত হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
—“নো নো মিস ভীতুর ডিম। এমন কাজ ভুলেও করবেন না।”
মুন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে যা দেখে লোকটা হেসে বলল,
—“আপনি যদি আমার গালে চড় মারেন তাহলে আমার ফর্সা গাল টা লাল হয়ে যাবে যা দেখে মানুষ হাসাহাসি করবে। মানে আমার মানসম্মানের পুরো বারো টা বেজে যাবে।”
মুন বিরক্তির সুরে বলল,
—“আপনি ফালতু কথা বড্ড বেশি বলেন। আর ক্যাবলাকান্তের মতো কথায় কথায় হাসেন। জানেন এগুলো কিসের লক্ষণ?”
লোকটা না বুঝার ভান করে বলল,
—“কিসের লক্ষণ?”
—“পাগলের।”
লোকটা চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলল,
—“আপনি কি করে জানলেন? আপনি কি পাগলের ডাক্তার? তাহলে বলুন না এর চিকিৎসা কি?”
মুন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—“পাবলিকের হাতে গণ প্যাদানি। দিনে দু বেলা খাবেন। দেখবেন পাগলামী একদম ঠিক হয়ে যাবে।”
বলেই মুন সামনে হাঁটতে লাগলো। লোকটা চেঁচিয়ে বলল,
—“এই যে মিস রাগীনি ফোন নম্বর টা দিয়ে যান। নাহলে অন্তত আপনার নামটা তো বলে যান।”
মুন যেতে যেতে পিছনে ফিরে চোখ রাঙিয়ে আঙ্কেল নাড়িয়ে শ্বাসায়। তা দেখে ছেলেটা বুকের বাম পাশে হাত দেয়। মুন সামনে ফিরে চলে যায়।
.
আঁধার সার্জারি শেষ করে বেরিয়ে ওলি’র কেবিনে যায়। গিয়ে দেখে ওলি ঘুমাচ্ছে আর মুন কেবিনে নেই। আঁধার মুন কে খুঁজতে শুরু করে। এদিকে মুন পুরো হসপিটাল ঘুরে ঘুরে দেখছে। অনেক বড় হসপিটাল। আর খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মুন ঘুরতে ঘুরতে বাচ্চাদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে চলে যায়। মুন দেখে ছোট ছোট বাচ্চারা কানামাছি খেলছে। মুন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখছিল। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে এসে মুনে আঙ্গুল ধরে টানে। মুন হাঁটু ভেঙ্গে বসে ছেলেটার সামনে ছেলেটা মুনের গাল টেনে ফোকলা দাঁতে হেসে দেয়। কি অমইক সেই হাসি। তারপর বলে,
—“এই যে ডল তুমি আমাদের সাথে কানামাছি খেলবে?”
মুন ছেলেটার গাল টেনে বলে,
—“আমি তো তোমাদের থেকে অনেক বড় আমাকে কি খেলতে নিবে?”
—“এই ইনা, মিনা, রাজু, টিনা, সবাই এদিকে আয় শোন।”
ছেলেটা ডাকার সাথে সাথে বাচ্চা গুলো দৌড়ে যায়। তারপর জিজ্ঞেস করে,
—“কি হয়েছে রে শান?”
—“ডল ও আমাদের সাথে খেলবে।”
—“ডল কে রে?”
শান আবার মুনের গাল টেনে বললো,
—“এই যে দেখ একদম জীবন্ত একটা ডল।”
টিনা মেয়েটা বলল,
—“আপু তুমি খেলবে আমাদের সাথে?”
—“হ্যাঁ।”
সবাই খুশি হয়ে ইয়ে বলে চিৎকার করে উঠলো। শান বলল সে সবাই কে ধরবে। তাই টিনা শানে’র চোখ বেঁধে দিলো।
কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছো!!
পূর্বে চাও পশ্চিমে চাও, যদি পারো আমায় ছো!!
বলেই খেলা শুরু করলো। সবাই শান কে ঘিরে রেখেছে। কেউ চিমটি কাটছে। কেউ চুল টানছে। কেউ আবার হালকা করে থাপ্পর ও মারছে। মুন বাচ্চাদের সাথে খেলায় মেতে উঠেছে। এদিকে যে একজনের তার চিন্তায় জান বেরিয়ে যাচ্ছে সেই হুঁশ নেই। আঁধার পুরো হসপিটাল জুড়ে মুন কে খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। মুনের জন্য চিন্তা হচ্ছে সাথে রাগ ও হচ্ছে। কত বার বলেছিল ও যেন ওখান থেকে কোথাও না যায় কিন্তু মুন তা শুনে নি। আঁধার একবার শুধু মুন কে পাক তারপর ঠাঁটিয়ে দিবে এক চড়। মুন কোথায় আছে আদোও হসপিটালে আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ লাগছে। এই হসপিটাল টা সেভেন ফ্লোলোরের। ওরা সেভেনে ফ্লোরেই ছিল। আঁধার সব গুলো ফ্লোর দেখেছে কিন্তু কোথাও মুন নেই। এখন শুধু সেকেন্ড ফ্লোর’ই বাকি আছে। শান মুনের লং স্কার্টের এক সাইড ধরে ফেলেছে। খিলখিল করে হেসে শান বলল,
—“ডল তোমাকে আমি ধরে ফেলেছি।”
শান চোখ থেকে কাপড়টা খুলে ফেলল। মুন বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলল,
—“ইশশ্। ধরা পরে গেছি।”
মুন হাঁটু গেড়ে বসে শান কাপড়টা দিয়ে মুনের চোখ বেঁধে দিলো। মুন বাচ্চাদের ধরার জন্য ওদের পিছনে ছুটছে। কিন্তু চোখ বাঁধা থাকায় কিছুই দেখতে পারছেনা। তাই এটা ওটার সাথে বারি খেয়ে নাজেহাল অবস্থা হয়েছে ওর। মুনের স্কার্টের এক এক কোনা ধরে বাচ্চারা টানছে। মুন কাউকে হাতের নাগালে পাচ্ছে না। চিমটি খেয়ে খেয়ে ওর করুন অবস্থা। হঠাৎ মুন কিছুর সাথে বারি খেলো। মুন হাত দিয়ে নাড়িয়ে চাড়িয়ে ভালো ভাবে দেখে বুঝলো মানুষ। মুন মনে করলো কোনো বাচ্চা তাই মুন জরিয়ে ধরে উৎফুল্ল কন্ঠে জোরে জোরে চিৎকার করে বলল,
—“ইয়ে ইয়ে পেয়েছি, পয়েছি ধরে ফেলেছি। কিন্তু এই সাইজের কোনো বাচ্চা হয়? এই পিচ্চু তুই খাস কি রে যে এই বয়সেই এইরকম তরতাজা সুঠাম দেহের অধিকারী হয়ে গেছিস?”
খুশি খুশি চোখ থেকে কাপড়টা সরাতেই ওর চোখ দুটো গোল গোল রসগোল্লার সেপের হয়ে যায়। মুন ফাটা ফাটা চোখে সামনে থাকা ব্যাক্তির দিকে তাকিয়ে ঢোক গেলে। পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। মুন কম্পিত কন্ঠে অস্পষ্ট সুরে বলল,
—“আ-আপ-নি।”
আঁধার মুনের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি ওই চোখের আগুন দিয়ে মুনকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিবে। ফর্সা মুখে লাল রেশ ফুটে আছে। চোখ মুখ কঠিন। মুনের তো আঁধার কে দেখেই জান যায় যায় অবস্থা। আঁধারের ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠে,
—“তুমি এখানে কি করছো? তোমাকে না আমি ওলি’র কেবিনে বসে থাকতে বলেছিলাম?”
আঁধারের এমন ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে মুন ভয়ে কেঁপে উঠে। আঁধার আবারো চেঁচিয়ে বলে,
—“অ্যান্সার মি?”
—“আ-আমি…..”
মুন কিছু বলতে পারছে না ভয়ে ওর সব কথা গলায় দলা পাকিয়ে গেছে। মুন ধমক এবার শুনে কেঁদেই দিলো। সব বাচ্চারা তাকিয়ে আছে। আঁধার ধমকের সুরে বলল,
—“ইউ হোয়াট?”
মুন অনেক কষ্ট কিছু শব্দ মুখ থেকে বের করে,
—“স-সরি মিস্-মিস্টার হাসবেন্ড।”
—” ‘সরি’ এই একটা ওয়ার্ড ছাড়া কি তুমি আর কিছু পারো?”
শান মুনের হাত টেনে নিচে বসালো তারপর চোখের জল মুছে দিয়ে মুনের গালে একটা চুমু খেলো। আঁধার আর মুন দুজনেরই চোখ চরক গাছ। শান বলল,
—“কেঁদো না ডল। আমি এই পচা আঙ্কেলটা কে বকে দিচ্ছি। তাও তুমি কেঁদো না। তোর চোখের জল আমার সহ্য হয় না।”
শানের এমন কান্ড দেখে আর কথা শুনের মুনের কন্না অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে দেছে। ৭/৮ বছরের বাচ্চার এমন কথা শুনে যে কেউই শক খাবে। শান এবার আঁধারের দিকে তাকিয়ে রাগি কন্ঠে বলল,
—“এই যে মিস্টার আপনি আমার ডল কে বোকছেন কেনো? দেখছেন আপনার জন্য আমার ডল কাঁদছে? সরি বলুন আমার ডল কে।”
আঁধার অবাক হয়ে শানের কথা শুনছে। বাচ্চা ছেলেটা ওকে সরি বলতে বলছে? আঁধার মুনের উপর অধিকার খাটিয়ে বলল,
—“ও আমার বউ তাই আমি ওকে বোকতে পারি। কাঁদাতেও পারি। তাতে তোর সমস্যা কোথায় রে?”
—“ডল আপনার বউ হোক বা বোন তাতে আমার কি? আপনি যদি ডল কে বকেন তাহলে আমি ডল কে বিয়ে করে আমার সাথে নিয়ে যাবো। তারপর দেখবো আপনি ডল কে কিভাবে বকেন।”
মুনের চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেছে। এই ছেলে বলে কি। আঁধার তর্ক করে বলল,
—“আমার বউ কে তুই আবার বিয়ে করে নিয়ে যাবি?”
—“হ্যাঁ।”
—“তোর সাহস তো কম না।”
—“আমি কি বাচ্চা নাকি যে ভয় পাবো?”
—“নাহ তোকে দেখে তো বাচ্চা মনেই হচ্ছে না। আচ্ছা তোর বয়স কত রে?”
—“আট বছর।”
—“ও হো অনেক বড় হয়ে গেছিস তো দেখছি। তা তুই আর কোনো মেয়ে পেলি না যে আমার বউ কে নিয়ে টানাটানি করছিস?”
শান একটু ভাব নিয়ে বলল,
—“মেয়েরা তো আমার পিছে লাইন লাগিয়ে ঘোরে। কিন্তু আমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলের জন্য ডল’ই পারফেক্ট। কিন্তু ডল তোমার মধ্যে কি এমন দেখলো যে তোমাকে বিয়ে করলো। তুমি তো দেখতে আমার চেয়ে বেশী হ্যান্ডসাম ও না।”
—“আমাকে তোর কোন দিক দিয়ে খারাপ মনে হচ্ছে। আর তুই ওর কোমর অবধি ও হবি কি না তা নিয়ে সন্দেহ। আবার আসছে বিয়ে করতে।”
—“আর কিছুদিন পরেই আমি ডলের সমান হয়ে যাবো। তারপর ডল কে বিয়ে করবো।”
এদের ঝগড়া শুনে মুনের মাথা ঘুরাতে। শান নাহয় বাচ্চা বুঝে না অবুঝ কিন্তু আঁধার? মুন না পেরে জোরে চুপ বলে চিৎকার করলো। আর সাথে সাথে সব চুপ হয়ে গেল। মুন আঁধারের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে বলল,
—“আপনি এতো বলল বুইড়া ব্যাটা হয়ে এই টুকু বাচ্চার সাথে ঝগড়া করছেন? ও কি বুঝে যে ওর সাথে আপনি তর্ক করছেন? আচ্ছা আলতু ফালতু কিছু খান নি তো আপনি?”
আঁধারের টনক নড়ে সে এতোক্ষণ কি করছিলো। একটা সাত বছরের বাচ্চার সাথে তর্কে নেমেছে সে। তাও মুনের জন্য নিয়ে। আঁধার নিজের কাজে নিজেই হতভম্ব। আঁধার মুনের কোনো কথাই না শুনে ওকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
—“কোনো কথা না বলে চুপচাপ আমার সাথে চলো।”
আঁধার মুন কে কারের ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মুন আবার জিজ্ঞেস করলো,
—“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
আঁধার ড্রাইভ করতে করতে সহজ ভাবে জবাব দিলো,
—“তোমাদের বাড়িতে।”
মুন অবাক হয়ে বলল,
—“হঠাৎ?”
—“হঠাৎ না আগেই ঠিক করা ছিল।”
—“কিন্তু আমরা তো জামা কাপড় ও নেই নি।”
—“সামনের মলের থেকে নিয়ে নিও। এখন একটু বকবক বন্ধ করে চুপ করে বসো।”
.
মুনের মনে হচ্ছে কত বছর পর জানি নিজের বাড়িতে আসছে। মুন কলিংবেল চাপতেই কেউ দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলো। মুন তাকে দেখে অবাকের শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মুন অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো,
—“তাহেরা আপু!”
চলবে,
#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_৮
তাহেরা মাথা নিচু মুখ কাচুমাচু করে মুনের সামনে বসে আছে। আর মুন অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাহেরার দিকে তাকিয়ে আছে। তাহেরা ভয়ে বার বার ঢোক গিলছে। তাহেরা অনেক কষ্টে সাহস করে মিনমিনিয়ে গলায় বলে,
—“সরি মুন। আমার জন্য তোর…….”
মুন তাহেরা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শ্বাসিয়ে বলল,
—“তোমার জন্য আমার জীবনটা টা শেষ হয়ে গেছে। তোমাকে হেল্প করে আমার নিজের লাইফটা হেল হয়ে উঠেছে। ওই শালা আঁধারের বাচ্চা আমার জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে দিয়েছে।”
তাহেরা কিছুই বুঝতে পারছেনা। তাই অবুঝ ভঙ্গিতে বলল,
—“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না মুন। কি বলছিস তুই এসব? উনি তোর লাইফ তেজপাতা করে দিয়েছে মানে?”
মুন যা হয়েছিল তার ঠিক উল্টো টা তাহেরা কে শুনাতে লাগলো,
—“তাহলে শোনো। বিয়ে শেষে বাসর রাতে আমি যখন ওই রাক্ষসটার রুমে বসে ছিলাম তখন হঠাৎ উনি রুমে ঢুকেই আমাকে ওনার বেড থেকে টেনে নামিয়ে ফ্লোরে ছুরে মারলেন। তারপর অনেক বাজে বাজে কথা বলতে লাগলো আমাকে, আব্বু কে আমাদের পুরো পরিবার কে। আমি তবুও একটা টু শব্দটিও করি নি। মুখ বুঝে সব সহ্য করেছি। ওনার বলা শেষ হতেই উনি বেডে গিয়ে শুয়ে আমার দিকে কুশন ছুরে মেরে বললেন নিচে নাহলে সোফায় গিয়ে শুতে। তাহলে ভাবো কত অসভ্য লোক? কারণ উনি নাকি আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মানেন না। ওই রাক্ষস টা নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসে। তাই আমি যেন তার কাছে কিছু আশা না করি। জানো আমি এতো কিছুর পরেও একটা কথাও মুখ থেকে বের করি নি। চুপচাপ ওনার কথা মতো সোফায় গিয়ে শুয়ে পরি। উনি সব সময় আমার সাথে ধমক মেরে কথা বলে। কখনো নরম গলায় মিষ্টি করে কথা বলে না। একটুও আদর করে না।”
—“তারপর!”
—“তারপর………”
বললে বলতে সামনে তাকাতেই মুন দেখে ওর যমরাজ দরজার সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। আঁধার আবারো সহজ ভাবে বলল,
—“তারপর বলো?”
মুন আঁধার কে দেখে শুকনো একটা ঢোক গিললো। আঁধারের মুখের ভাব ভঙ্গি এখনো সাধারণ। তাহেরা আস্তে করে কেটে পরল। আর যাওয়ার আগে মুনের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
—“বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। এখন আমি যাই।”
মুন শুধু অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না। আঁধার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর ধীরে ধীরে মুনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মুনের ছোট্ট প্রান পাখি উড়ে যায় যায় অবস্থা। মুন পেছাতে পেছাতে তোতলা আওয়াজে বলল,
—“আ-আপনি আ-আগাচ্ছেন কে-কেনো?”
—“তুমি পেছাচ্ছো তাই?”
—“দেখুন….”
—“দেখতেই তো আসছি।”
—“একদম কাছে আসবে না বলে দিচ্ছি।”
মুন পেছাতে পেছাতে একদম দেয়ালের সাথে মিশে যায়। আর পেছানোর কোনো জায়গা নেই। মুন পারলে এখন দেয়ালের ভিতর ঢুকে যেত। আঁধার আসতে আসতে একদম মুনের কাছে এসে গেছে। আঁধার আর মুনের মধ্যে এক হাতের দূরত্ব। মুনের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। এই প্রথম বার কোনো পুরুষের এতো কাছে এসেছে। মুনের দম বন্ধ হয়ে আসছে। ও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হৃদপিন্ডটা জোরে জোরে লাফাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বেরিয়ে আঁধারের বুকের সাথে বারি খাবে। আঁধার হয়তো মুনের হার্ট বিট খুব ভালো করেই শুনতে পারছে। আঁধার আরেকটু মুনের দিকে আঘাতেই মুন চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলল,
—“প্লিজ, প্লিজ এরকম কিছু করবেন না।”
আঁধার ভ্রু কুঁচকে বলল,
—“কেনো? একটু আগে তুমিই তো তোমার বোনকে বলে ছিলে, আমি তোমার সাথে মিষ্টি করে কথা বলি না। তোমাকে আদর করি না। তাহলে এখন কি প্রবলেম?”
মুন চোখ বন্ধ রেখেই করুন সুরে বলল,
—“আর জীবনে ও বলব না। এবারের মতো মাফ করে দিন।”
আঁধার মুনের থেকে দূরে সরে গেল তারপর বলল,
—“এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। আর পড়াশোনায় ফোকাস করো। এবার কান ধরে একপায়ে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকো?”
বলেই আঁধার বেডে গিয়ে বসল। আঁধারের কথা শুনে মুন দ্রুত চোখ খুললো আর দেখলো আঁধার বেডে বসে আছে। আঁধার আবারো বলল,
—“মুখটাকে পেঁচার মতো করে এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? কথা কানে যায় নি? কান ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছি।”
মুন মিনমিন করে বলল,
—“এটা কিন্তু অন্যায়। আপনি এটা করতে পারেন না।”
আঁধার ভ্রু বাকিয়ে বলল,
—“আমি কি করতে পারি সেটা দেখতে চাও? দু’মিনিটের মধ্যে কান ধরে এক’পায়ে না দাঁড়ালে একটু আগে যেটা করা বাকি ছিল সেটা এখন করব।”
মুন এ কথা শুনে দ্রুত কান ধরে এক পায়ে দাঁড়ালো। মুন ইনোসেন্ট ফেস করে আঁধারের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আঁধারের সেদিকে কোনো ভুক্ষেপ নেই। সে তো মহা মূল্যবান কাজ ইয়ানি মোবাইল টিপতে ব্যস্ত। মুন মনে মনে বলে,
—“আমার জীবনটা মনে কান ধরে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই পাড় হয়ে যাবে।”
.
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। পশ্চিম আকাশে লাল টকটকে আগুনের গোলার মতো সূর্য টা ধীরে ধীরে সাগরের বুকে মিশে যাচ্ছে। আকাশ নিজেকে কমলা, লাল ও হলুদ রঙের মিশ্রণে নিখুঁত ভাবে সাজিয়েছে। মনে হচ্ছে কেউ খুব যত্ন নিয়ে এই আকাশ টা কে এঁকেছে। গাছপালার রং ও কমলা মনে হচ্ছে। চারদিকে মন ভোলানো মুগ্ধ বাতাস বইছে। সেই বাতাসের সাথে সাথে উড়ছে কোমর অবধি লম্বা কালো চুল। খুব খোশ মেজাজে নদীর পাড়ে কবির খানের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে মুন। আদরের কন্যার আবদারেই তার এখানে আসা। কবির খান খুব আদর যত্নে বড় করেছে এই মেয়েটিকে। যখন যেটা চেয়েছে সেটাই এনে দিয়েছে। না চাওয়ার আগেই পারলে সামনে এনে হাজির করত। বড্ড অভিমানী মেয়ে তার। সাথে রাগ আর জেদ তো ভরপুর আছেই। কিন্তু কখনো তার কথা উপর কথা বলেনি। কখনো কোনো আদেশ অমান্য করেনি। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বিয়ের কথাটাই বলা যায়। কবির খান আড়ালে চাপা শ্বাস ছাড়লেন। সে কি কোনো অপরাধ করেছে? সে তার ছোট্ট মেয়েটির প্রতি অন্যায় করে নিত? ওর জীবনটা নষ্ট করে দেয় নি তো? মুন সংসার জীবনের জন্য এখনো অনেক ছোট। মুন এসবের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়। কিন্তু কবির খানের আঁধারের উপর পুরো বিশ্বাস আছে। আঁধার তাকে কথা……..। মুনের কথায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ে বাস্তবে ফিরলো কবির খান।
—“আব্বু একটা কথা জিজ্ঞেস করব? রাগ করবে না তো?”
—“বলো?”
—“আমি শুনেছিলাম মেয়েরা বোঝা হয়ে গেলে নাকি বাবা-মায়েরা তাদের বিয়ে দিয়ে বিদায় করে দেয়। আচ্ছা আমিও কি তোমাদের কাছে অনেক বেশী বোঝা হয়ে গেছিলাম আব্বু?”
ছলছল চোখে খুবই করুণ স্বরে কথাটা বলল মুন। মুনের এই কথাটা শুনে কবির খানের বুকে তীব্র ব্যথা করতে লাগলো। তার মেয়ে তার কাছে বোঝা এটা সে কখনোই মানতে পারছে না। সে পারলে মুনকে সারাজীবন নিজের কাছে খুব যত্নে আগলে রেখে দিত। সে তো চায়নি তার এই ছোট্ট মেয়েটি কে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে। সে তো স্বপ্নে ও এ কথা ভাবেনি। কিন্তু হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেলো। একটা ঝড় এসে সব কিছু উলট পালট
করে দিলো। দিনটা শুভ ছিলো নাকি অশুভ ঠিক করতে পারছে না কবির খান। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর ভাবতে চায়না সে। সব কিছু দূর স্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে চায়। কিন্তু সেই দূর স্বপ্নের সাথে অপ্রত্যাশিত ভাবে তার কলিজার টুকরা মেয়ে ও জড়িয়ে গেছে। মুন আবারো বলল,
—“কি হলো আব্বু বলো আমি কি তোমাদের কাছে সত্যি’ই বোঝা হয়ে গেছিলাম?”
কবির খান মেয়েকে আচমকা বুকে জড়িয়ে নিলেন। সে জানে তার অভিমানী কন্যা টি খুব বেশি অভিমান করেছে তার ওপর। কবির খান মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বুকের জ্বালা মেটাচ্ছে। সে যে এই মেয়ের চিন্তায় ঠিক মতো রাতে ঘুমাতে পারে না তা কী তার এই অভিমানী কন্যা টি জানে? না জানে না। কবির খান স্নেহময়ী কন্ঠে বলল,
—“আমার মেয়েদের কখনো আমি বোঝা মনে করিনি। তোমরা দুজন তো আর দুই মা। দুটি জান্নাত আমার। তাহলে বলো মা কে কি কখনো সন্তানেরা বোঝা মনে করে?”
মুন অভিমানী কন্ঠে বলল,
—“তাহলে তুমি কেনো আমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলে?”
—“সেটা তো বলতে পারবো না আম্মু। কিন্তু একটা জিনিস বলতে পারবো। আল্লাহ কে সবসময় চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবে। মনে রাখবে আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। কিন্তু আমরা সেটা তখন বুঝতে পারি না। কিন্তু পরে ঠিকই বুঝতে পারি।”
মুন আর কিছু বলল না। শুধু মাথা নাড়লো। কারণ সে সব থেকে বেশী বিশ্বাস নিজের প্রাণ প্রিয় আব্বু কে করে। তার আব্বু কখনো না ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। আর যে সিদ্ধান্ত নেন সেটা ঠিকই হয়। মুন আইসক্রিম খাবে বলে কবির খানের কাছে আবদার করল। আর কবির খান ও হাসি মুখে মেয়ের জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসতে গেল। কবির খানের ভিতরে লুকিয়ে আছে অনেক কথা অনেক রহস্য যা সে সবার থেকে আড়াল করে রাখতে চান। মুনের বিয়েটা যতটা সহজ ও স্বাভাবিক দেখাচ্ছে আসলে ততটা স্বাভাবিক না। অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে এর পিছনে। যা শুধু কয়েক জন ছাড়া কেউ জানে না।
.
রাত ১১:৪৫ বাজে। একটু আগেই খাওয়া দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রুমে এসেছে মুন আঁধার। কিন্তু কথা হলো আঁধার এখন ঘুমাবে কোথায়? মুন আঁধারের জন্য জায়গা রেখে এক সাইডে করে শুয়ে পরেছে। আঁধার কোমরে হাত দিয়ে ভ্রু উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুনের সে দিকে ভাবান্তর নেই। আঁধার ভারি কন্ঠে বলল,
—“আমি ঘুমাবো কোথায়?”
মুন আলসেমি কন্ঠে বলল,
—“আপনি কি অন্ধ?”
আঁধার রাগি কন্ঠে বলল,
—“মানে? তুমি কি মজা করছো আমার সাথে?”
—“আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না আমি আপার জন্য পাশে জায়গা রেখে সাইড করে শুয়েছি? তারপরও আবার জিজ্ঞেস করছেন কোথায় ঘুমাবেন? তার মানে তো এ’ই যে আপনি চোখ থাকতেও অন্ধ।”
আঁধার চেঁচিয়ে বলল,
—“হোয়াট আমি তোমার সাথে বেড শেয়ার টকরবো? ইমপসিবল। এর থেকে আমি নিচে ফ্লোরে ঘুমাবো।”
মুন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
—“অ্যাজ ইউর উইশ। আজ রাতে ইঁদুর আর তেলাপোকা’র সাথে পিকনিক করবেন কেমন।”
বলে মুন চোখ বন্ধ করে নিলো। আঁধার একটা পাটি আর বালিশ নিয়ে নিচে শুয়ে পরলো। কিন্তু ঘুম আসছে না তার এপাশ ওপাশ করতে করতে ১২টা বেজে গেছে। আঁধার উঁকি দিয়ে দেখে মুন ঘুমিয়ে গেছে। তাই আঁধার উঠে ধীর পায়ে গিয়ে মুনের পাশে শুয়ে পরলো। আঁধার চোখ বন্ধ করে আছে হঠাৎ মনে হলো ওকে দুটো হাত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। আঁধার চোখ খুলে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে মুন কে দেখে।
চলবে,