অনুগল্প:- প্রত্যাবৃত লগ্ন

0
1912

অনুগল্প:- প্রত্যাবৃত লগ্ন
আফসানা

কলকল করে বয়ে চলা অশান্ত নদীর ওপর অবস্থিত এক ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অহনা। উদ্দেশ্য সুই*সাইড করবে। কপোলের তিল ছুঁয়ে কষ্ট, য*ন্ত্রণা, না পাওয়ার আক্ষেপের অশ্রুবারি নিঃশব্দে গড়িয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে কোথাও। ভাবছে এই পঁচিশ বছরের জীবনে কী পেল ও? না পেল জন্মদাত্রী মায়ের পূর্ণাঙ্গ স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা। আর না পেল বাবার আদর। মা তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। বাবা সৎ মায়ের কথায় উঠেবসে। সেখানে আদর ভালোবাসাটা পাবে কীভাবে? বাবা তো দ্বিতীয় বিয়ের পর অন্ধ হয়ে গেছে। ওকে আর চোখেই লাগে না। মায়ের মৃত্যুর আগে বেশ কিছু টাকা অহনার হাতে দিয়ে গিয়েছিল পড়াশোনার জন্য। অথচ মা চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে। সেই টাকা চিকিৎসায় খরচ না করে মেয়েকে দিয়ে গেলেন। হয়তো উনি বুঝে গিয়েছিল দুনিয়াতে উনার স্থায়িত্বকাল খুবই অল্প। আর উনার মৃত্যুর পর যে অহনা পথে বসার মতো অবস্থা হবে সেটাও জানতেন। কারণ বাবা যে থেকেও নেই। পরে তো আরো থাকবে না। মায়ের মৃত্যুর পর অহনা অনেক চেষ্টায় পড়াশোনাটা চালিয়ে নিয়েছে। কলেজের সময়টুকু বাদে টিউশন করিয়েছে। সেই টাকাতেই পড়াশোনা ও হাতখরচ চালিয়েছে। খুব বেশি বিপদ না হলে মায়ের টাকায় হাত দিত না সে। কেন যেন টাকাগুলো দেখলেই অহনার কান্না পেত।

মায়ের মৃত্যুর পর ঘরে শান্তি পায়নি একদিনও। সারাক্ষণ বিষণ্ণ সময় কাটাতো অহনা। একটুখানি শান্তির পরশ হয়ে একটা ছেলে এলো ওর জীবনে। ঘরে যতটা অশান্তি পেত সে এক নিমিষেই তা দূর করে দিত। ম্যাজিকের মতো ছিল সে অহনার জীবনে। বাসস্থানহীন এক অসহায় পাখি এক টুকরো খড়কুটো পেল যেন। তা আঁকড়ে ধরেই নতুন করে ঘর বাঁধতে চেয়েছে। একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু সে যে জানতো না ছেলেটা ছিল চুন। যা খেয়ে জিহ্বা পুড়িয়ে ফেলেছে অহনা। বেঁচে থাকার আর কোনো মানেই যে রইলো না। এত ভালোবেসে, এত এত অঙ্গীকার সেই সবই কী তাহলে মিথ্যে ছিল! এভাবে কেন ধোঁ*কা দিল ওকে? এভাবে কেন ভিতর থেকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিল? সে তো নিজ থেকে যায়নি তার কাছে। তাহলে কেন এই প্রতারণা! কী দোষ ছিল তার? ‘ইফাদ’ নামের মতোই ফাঁদে ফেলে ওকে পুরো বরবাদ করে দিয়েছে। এই প্রতারকের নাম ও কোনোদিন ভুলবে না। অবশ্য মনে রাখবেই বা কীভাবে! আজ তো ও এখানে মরতে এসেছে। মরে গিয়েও বুঝি কাউকে মনে রাখা যায়! নিজের সাথেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো অহনা। পৃথিবীটা সুন্দর হলেও অহনার কাছে অসুন্দর। এই পৃথিবীর মানুষগুলো অসুন্দর, কু*ৎসিত মনের। তাই নোংরা মনের মানুষদের নিঃশ্বসের ভিড়ে বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। ও মরে গেলেও কারো কিছু যাবে আসবে না। বরংচ বাবার ঘাড়ের ওপর থেকে বোঝা নামবে। এই অসুন্দর পৃথিবীতে আজই অহনার শেষ দিন।

ব্রিজের এই পাশটায় রেলিং নেই। কেবল ছোটো ছোটো পিলার রয়েছে। ব্রিজের একদম পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অহনা। মাত্র এক পা এগোলেই ও এই বিশাল জলরাশির গহ্বরে হারিয়ে যাবে। কেউ কোনোদিন খুঁজে পাবে না ওকে। ‘অহনা’ নামের একটা দুঃখী মেয়ে ছিল সেটাও হয়তো এই পৃথিবী মনে রাখবে না। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকালো অহনা। বিড়বিড় করে বললো
—“আমাকে ক্ষমা করে দিও মা। আমি তোমার কথা রাখতে পারিনি। তোমার মেয়ে ডাক্তার হবে সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। ভুল পথে চলে গিয়েছিলাম। অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমাকে মাফ কোরো। আমি হেরে গেলাম মা। তোমার মতোই জীবন যু*দ্ধে হেরে গেলাম। আমাকে একা ফেলে কেন চলে গেলে মা? তুমি তো জানতে এ পৃথিবীটা নি*ষ্ঠুর, এই পৃথিবীর মানুষগুলো পা*ষণ্ড। কেন আমাকে তোমার সাথে নিয়ে গেলে না? তোমাকে খুব মিস করি মা। আমি আসছি তোমার কাছে। তোমার কাছ থেকে অগণিত আদর আলোবাসা পাওয়া বাকি আছে যে। তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে থাকবো আমি মা। আমার আর কিছু লাগবে না। তোমার গায়ের গন্ধটা আমি আত্মস্থ করতে চাই।”

চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নিঃশব্দ অশ্রুকণা। ঠোঁটের কোণে দৈবশিশুর মতো এক চিলতে মিষ্টি হাসি। কতদিন পর মায়ের সাথে দেখা হবে! আজই তো খুশির দিন অহনার। ডান পা টা তুলে সামনে বাড়ানোর আগেই আচমকা এক পুরুষালী কণ্ঠে থমকে গেল অহনা। সামনে বাড়িয়ে রাখা পা আগের জায়গায় নিয়ে এলো। কম্পিত বুকে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চোখ বন্ধ করে।

—“বললেন না তো, আপনার কাছে জীবনের আসল মানে কী?”

এমন নিরিবিলি জায়গায়, যেখানে একটা কাকপক্ষীও নেই; সেখানে এই অপরিচিত লোকটার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে অহনা আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল। ধীরে ধীরে চোখ মেলে পাশে তাকালো অহনা। কনে দেখা আলোয় অবলোকন করলো এক শ্যামসুন্দর আকর্ষণীয় পুরুষকে। পিলারে হেলান দিয়ে পকেটে হাত গুঁজে আধবসা হয়ে চেয়ে আছে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে। অহনা নির্লিপ্ত ভঙিতে চোখ সরিয়ে নিল। এই পৃথিবীর সব পুরুষকেই ও ঘৃণা করে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো
—“হঠাৎ এসে অপরিচিত একটা মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করা কোন ধরনের ভদ্রতা? আমাকে চিনেন আপনি? না চিনে গায়ে পড়ে কথা বলছেন কেন?”

দৈবক্রমে উড়ে আসা যুবক একটুও বিরক্ত হয়নি। বরংচ একপেশে হেসে বললো
—“ভালো থাকার সংগা জানেন আপনি?”

বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে এলো অহনার। উটকো ঝামেলাটা কই থেকে চলে এলো ওকে জ্বালাতে? আরেকটু পরে আসলে হতো না! এখনই আসতে হলো! এবার লোকটার মুখোমুখি হয়ে কিড়মিড় বললো
—“আপনাদের মতো ছেলেরা আমার চোখের বিষ। দয়া করে এখান থেকে বিদেয় হন।”

কোনো কথায় পাত্তা না দেওয়া লোকটা শান্ত কোমল দৃষ্টিতে অনিমেষ তাকিয়ে রইলো অহনার দিকে। ওর ফোলা ফোলা চোখ দুটোর দিকে চেয়ে বললো
—“একজনের জন্য পৃথিবীর সব ছেলেদের দোষারূপ করাটা কি ঠিক ম্যাডাম? পৃথিবীতে সব পুরুষ খারাপ হলে একটাও ভালো বাবা থাকতো না, একটাও ভালো ভাই থাকতো না, একটাও ভালো জীবনসহচর থাকতো না, একটাও ভালো সন্তান থাকতো না।”

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মানুষটার দিকে। কে এই যুবক? ওর ব্যাপারে কীভাবে জানে? হঠাৎ কোত্থেকে এসে এসব বলছে? আকাশ থেকে কি টুপ করে ওর সামনে এসে পড়লো? অহনা চোখ সরিয়ে নদীর দিকে চেয়ে বললো
—“ঠিক বেঠিকের বিচার করতে চাইলে অন্যকোথাও গিয়ে করুন। ভালো পরিচিতি পাবেন। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি এনিমোর।”

লোকটা আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে বললো
—“আমাদের জীবনটা খুব ছোটো। সেই ছোটো জীবনটা ছোট্ট ছোট্ট খুশির মুহূর্ত দিয়ে, আপনজনদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অনায়াসেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। সুই*সাইড কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না।”

অহনা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে নিজের সাথেই যেন ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বললো
—“হাহ্! আপনজন, ভালোবাসার মানুষ থাকলে না তাদের সাথে সুখে দুঃখে জীবন পার করে দেব!”

এরপর তার উদ্দেশ্যে বললো
—“এসব দার্শনিক কথাবার্তা আমাকে না বলে অন্যথা যাকে তাকে বলুন গিয়ে। অন্তত আপনার চাপার জোর ক্ষয় করার জন্য পরে কোনো আফসোস থাকবে না।”

লোকটা যেন অহনার কথা শুনতেই পায়নি। নিজের মতো বলতে লাগলো
—“মানুষের জন্ম একবার, মৃত্যুও একবার। আর সে জীবনটা মানুষ একবারই উপভোগ করতে পারে। যারা যথাযথভাবে সৌন্দর্যময় পৃথিবীর উপভোগ্য জিনিসগুলো উপভোগ না করে মরার চিন্তা করে, তাদেরকে বোকা বৈ অন্যকিছু বলা যায় না। নিজের অমূল্য জীবনটা কী এতটাই নগন্য যে কিছু তুচ্ছ কারণে, কিছু তুচ্ছ মানুষদের জন্য বরবাদ করে দিবেন! নিজের কাছে কি নিজের মূল্যাতীত জীবনের কোনো দামই নেই? কারো মিথ্যা ভালোবাসার ছলনায় পড়ে নিজেকেই ভালোবাসা বাদ দিয়ে দিবেন! এমন ভালোবাসার দরকার নেই তো। আগে নিজের সত্ত্বাকে ভালোবাসুন। নিজেকে এত তুচ্ছজ্ঞানহীন ভাববেন না। কারো কাছে হয়তো আপনার মূল্য অনেক বেশি। সেটা এখন বুঝতে না পারলেও সময় হলে ঠিকই বুঝবেন। হতাশ হয়ে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন না।”

যত শুনছিল ততই বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়ছিল অহনা। এমন সুন্দর করেও কেউ কথা বলতে পারে! এমন সুন্দর চিন্তাধারাও কারো হয় বুঝি! কই তার সাথে তো কখনো পরিচয় হলো না এমন কারোর। হলে তো আজ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতো না ও। আর এত তাড়াতাড়িই জীবনের প্রতি তিক্ততা আসতো না। লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো
—“আপনাকে শেষমেশ কয়েকটা অ্যাডভাইস দিই। আশা করছি লাইফে কাজে লাগাবেন।
‘কখনো হতাশ হবেন না। মনে রাখবেন, উপরওয়ালা এক দরজা বন্ধ করে দিলে বান্দার জন্য রহমতের হাজারটা দরজা উন্মুক্ত করে দেন।’
যেকোনো পরিস্থিতি ট্যাকল করার সৎসাহস রাখবেন মনে। ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাবেন না। সবসময় মনে রাখবেন, ভয়ে গুটিয়ে যাওয়ার চেয়ে মোকাবেলা করে পরাজিত হওয়ার মাঝেও স্বস্তি আছে।’
নিজের স্বপ্ন পূরণে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিন। হেলাফেলায় দিন কাটিয়ে নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎটা নষ্ট করবেন না। সহস্র মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া বাকি জীবনে। সেই অনুযায়ী প্রতিটা ফুটস্টেপ বুঝে শোনে ফেলবেন।’
‘অনেক সময় পড়ে আছে সামনে। কেবল পড়াশোনায় ফোকাস করবেন। সাফল্য আপনাকে ধরা দেবেই। প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তখন আর কারো সমালোচনায়ও আপনার কিছু যাবে আসবে না। বরং সমালোচকদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের অবস্থান বুঝিয়ে দেবেন।’
সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করবেন। দুঃখ-কষ্ট-না পাওয়ার বেদনা সবার জীবনেই থাকে। তা ধরে বসে থাকলে জীবন চলবে না। হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করলে মনও ভালো থাকবে। আর মন ভালো থাকলে সবকিছুই ভালো লাগবে।’
সবশেষে বলি, ‘এই বয়সে আসার আগ পর্যন্ত কোনো প্রণয়ঘটিত সম্পর্কে জড়াবেন না। হতে পারে কেউ আপনার প্রতীক্ষায় থাকবে এই অবস্থানে আসা পর্যন্ত। ততদিনে আপনিও যথাস্থানে এসে সেই প্রতীক্ষমাণ ব্যক্তির অপেক্ষার স্তব্ধতা ভেঙে দেবেন। আপনার অপেক্ষায়ই কিন্তু থাকবে সে। এবার আসি আমি।”

এমন রহস্যময় কথা শুনে মাথা ঘুরতে লাগলো অহনার। উপদেশগুলো তো ভালোই ছিল। কিন্তু শেষের কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারলো না। লোকটা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই অহনা দ্রুত ডেকে উঠলো। কয়েক কদম সামনে গিয়ে থামলো সেই যুবক। সম্মোহনী হাসি সমেত ফিরে তাকালো অহনার দিকে। সে তড়িৎ জানতে চাইলো
—“শেষের কথাটা বুঝতে পারিনি। এই বয়সে আসার আগ পর্যন্ত মানে?”

যুবক ছেলেটা পকেটে হাত গুঁজে বললো
—“সেটা অতিশীঘ্র বুঝতে পারবেন। কেবল কথাগুলো মাথায় রাখবেন সবসময়।”

আবারো চলে যেতে পা বাড়াতেই অহনা বললো
—“বুড়ো জ্ঞানীদের মতো একটানা লেকচার দিয়ে গেলেন। অথচ আপনার নামটাই তো বললেন না।”

রহস্যমানব ফের রহস্যময় হেসে বলে
—“পৃথিবীটা কমলালেবুর মতো চ্যাপটা। আশা করছি দেখা হবে আবারো। প্রতীক্ষায় থাকবেন কিন্তু প্রতীক্ষমাণ ব্যক্তির জন্য।”

ধাঁ করে যেভাবে উদয় হয়েছিল সেভাবেই চোখের পলকে যেন উধাও হয়ে গেল মানুষটা। অহনা পিছু নেওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগেই হোচট খেয়ে পিছনের দিকে হেলে পড়লো। ধীরে ধীরে পড়ে যেতে লাগলো ঊর্মিমালার অতল গহ্বরে। চোখে ভেসে উঠলো শ্যামসুন্দর আকর্ষণীয় এক রহস্যময় পুরুষের মুখাবয়ব। তাঁর মনোমুগ্ধকর হাসিটা হৃদয়ে আটকে গেল চিরস্থায়ীভাবে।

_________

“নাআআআআআ…….”

চিৎকার করে ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলো অহনা। কম্পিত বুকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখলো ও এই মুহূর্তে কোথায়। মনে হচ্ছিল ও নিজেই যেন নদীর গভীরে পড়ে গেছে! চিমটি কেটে দেখলো স্বপ্ন দেখেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। উঠে গিয়ে দ্রুত গলা ভেজালো। ঐ সুপুরুষ মানুষটার কথাগুলো যেন এখনো কানে বাজছে। কী মনে হতেই দ্রুত খাতা কলম নিয়ে বসে গেল। যতটুকু স্মরণ আসছে দ্রুত লিখতে লাগলো। লেখা শেষ হতেই কলম কামড়ে ভাবতে লাগলো ঐ পূর্ণবয়স্ক রমণীর চেহারার আদল ওর মতো কেন? উনার জীবনের সাথে পুরোপুরি মিল কেন ওর জীবনধারা? উনার মতো একই ঘটনা তো ওর সাথেও ঘটছে। যদিও সবগুলো ঘটনা এখনো ঘটেনি। মায়ের কথা মনে পড়তেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। আসলে কে উনি! উনারও মা মারা গেছে! উনার বয়স ছিল পঁচিশ। আর ওর বয়স এবার উনিশে পড়লো। একটা কথা মনে হতেই ভয়ে ঘেমে গেল। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। সেই রমণী কী আসলে অহনা নিজেই ছিল! ও মাই গড! সর্বাঙ্গ কেঁপে লোমকূপ কাঁটা কাঁটা হয়ে গেল এক মুহূর্তেই। এটা কী ছিল? এমন স্বপ্ন কেন দেখলো ও? ওকে কি আগে থেকেই হুঁশিয়ারি করে দিচ্ছিল? কীভাবে সম্ভব এটা? কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কী! সে জানে না। কিন্তু অতীতে যা ঘটেছে তার সবই তো মিলে। এখন সামনে যা কিছু ঘটবে তা যে মিলবে না এটার গ্যারান্টি দিতে পারছে না অহনা। ভয়ে অস্থির লাগছে অহনার। দু’হাতে চুল খামচে ধরলো। ঐ ইফাদ নামের ছেলেটা অ্যাডমিশন নেওয়ার পর থেকেই ওর পিছনে লেগে আছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নরকম সহমর্মিতার বাণী শোনায়। তাতে অহনা গলতেও শুরু করেছে। নাহ, আর গলে যাওয়া চলবে না। স্বপ্নেই যেন ও চুন খেয়ে মুখ পুড়িয়ে বসে আছে। আর এই চুনটা যে স্বয়ং ইফাদ তা বুঝতে পারছে অহনা। এখন এই ঝামেলা ওর ঘাড় থেকে কীভাবে নামানো যায় তা ভাবতে হবে।

চারটা বাজতে চললো। কিছুক্ষণ পরই আজান দিবে। এখন আর ঘুম আসবে না অহনার। শুতেই স্বপ্নে দেখা সুপুরুষের কথা মনে পড়ে গেল। এই লোকটাকে আগে কোনোদিন দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। উফ! বাস্তবে না দেখেই তো প্রেমে পড়ে গেল। এত সুদর্শন ছেলের সাথে আসলেই কি কোনোদিন দেখা হবে ওর? শোয়া থেকে উঠে বসে গেল। ইচ্ছে করলো তাঁর বলা কথাগুলো একেবারে আত্মস্থ করে নিতে। টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে খাতাটা মেললো। একটা মানুষের চিন্তাধারা এত মোহনীয় হয়! কী সুন্দর উনার কথাগুলো! শেষ কতকগুলো লাইনে চোখের সাথে সাথে শ্বাসটাও আটকে গেল। কলিজাটা লাফ দিয়ে উঠলো যেন। এই বয়সে আসার আগ পর্যন্ত প্রেমে না জড়াতে। তার মানে পঁচিশ বছরের ভিতর প্রেমে না জড়াতে বলেছে! আর কে প্রতীক্ষায় থাকবে তখন? সত্যি সত্যিই কি পঁচিশ বছর পূর্ণ হলে প্রতীক্ষমাণ ব্যক্তির সাথে দেখা হবে? কার কথা বলেছে সেই রহস্যময় সুপুরুষ? এই স্বপ্নের মাধ্যমে কি ওকে সতর্ক করে দিচ্ছিল? তার মানে কি ও সেই সময়টায় পৌঁছালে আত্মহত্যা করতে যেত? কেঁপে উঠলো অহনা। এই জন্যই বলেছে কথাগুলো! যত ভাবছে ততই যেন অতলে হারিয়ে যাচ্ছে অহনা। কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। রাতের ঘুমও হারাম হয়ে গেল।

___________

—“আমাকে এড়িয়ে চলছো কেন অহনা? কী করেছি আমি? আমি যে এতে কষ্ট পাচ্ছি তুমি বুঝতে পারছো না?”

কাঁধের ব্যাগটা শক্ত হাতে চেপে ধরে আছে অহনা। বেশ কয়েকদিন যাবৎ ইফাদকে এড়িয়ে চলছে ও। স্বপ্নটা এতটাই প্রভাব ফেলেছে ওর জীবনে যে ঐ লোকটার কথা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না। এমনকি কেন যেন ইফাদকেও বিরক্তিকর লাগছে এই মুহূর্তে। অহনা জানে না আদৌ ঐ লোকটার সাথে দেখা হবে কি-না! কিন্তু ওর অবচেতন মন বলছে অপেক্ষা করতে তাঁর জন্য।

অহনা ভ্রু কুঁচকে নির্লিপ্ত স্বরে বললো
—“আপনি কিসে কষ্ট পাচ্ছেন না পাচ্ছেন তা আমি বুঝে কী করবো? আর আমি আপনাকে এড়িয়ে যাওয়ারই বা কে? আমি কেবল পড়াশোনায় ফোকাস করতে চাই। অন্য কোনো দিকে তাকানোর সময় আমার নেই।”

বলেই পা বাড়াচ্ছিল। এর আগেই ইফাদ হাত ধরে থামিয়ে দিল। অহনা সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিল। ইফাদ বললো
—“সবকিছু তো ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তোমার কী হয়ে গেল? এমন বিহেভ করছো কেন?”

অহনা বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালো। নিজেকে যথাসম্ভব ঠাণ্ডা করে শীতল কণ্ঠে বললো
—“আমি কি আপনার মতো টু টাইমিং করছি? যা করছেন তা কন্টিনিউ করে যান। কিন্তু নেক্সট টাইম আমার পথ আগলে দাঁড়াবেন না।”

ইফাদ মনে মনে ভয় পেয়ে গেল। অহনা কি কোনোভাবে অন্য মেয়ের সাথে তাকে দেখে ফেলেছে? শুকনো ঢোঁক গিলে কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু গলা দিয়ে চিঁউচিঁউ বাদে কোনো আওয়াজ বের হলো না। ধাতস্থ হতেই দেখলো অহনা সামনে নেই।

অহনা পা ফেলতে ফেলতে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে বিড়বিড় করলো “ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস তো আমার সেদিনই উঠে গেছে, যেদিন বাবা মায়ের উপর প্রথম হাত তুলে। রোগে শোকে ভুগে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে। অথচ ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিল বাবা-মা। চোখের সামনে দেখেছি একটা মানুষকে কত দ্রুত বদলে যেতে। সেখানে আপনাকে কীভাবে বিশ্বাস করতে যাচ্ছিলাম আমি? অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম বোধহয়। আর অসহায় এই আমার পিছনে কেন পড়ে ছিলেন আপনি? কিসের লোভে সহানুভূতি দেখিয়েছেন? দেওয়ার মতো তো কিছুই ছিল না আমার কাছে। তাহলে কি… দেহের লোভে?”

গার্লস হোস্টেলে ঢুকে বিক্ষিপ্ত মনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে অহনা। সৎ মা ঘরে আসার পর সে আর টিকতে পারলো না সেখানে। বেরিয়ে যেতে হলো মায়ের গন্ধ মিশে থাকা সেই ছোট্ট ঘর থেকে। বাবা নামক মানুষটা নিজের রক্তকেও ভুলে গেল। এরপর এসে এই হোস্টেলে উঠে। টিউশনি আগে থেকেই করাতো। এখানে আসার পর আরো কয়েকটা বাড়িয়ে দেয়। একটু কষ্ট হলেও মানসিক শান্তি তো পাওয়া যায়!

__________

অহনার সং*গ্রামী জীবনের প্রায় ছয়টা বছর কেটে গেছে। সেই রহস্যময় সুপুরুষের প্রতিটি কথা মনে রেখে সেভাবেই এগিয়ে গেছে জীবনে। অবশেষে জীবন যু*দ্ধে জয়ী হয়েছে সে। শত ঝড়ঝাপটায়ও নিজেকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। মোকাবেলা করে গেছে প্রতিটি দুর্যোগের সাথে। কারো অন্তরজ্বলা কথায়ও অহনা কখনো দমে যায়নি। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করেছে অহনা। নিজেকে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলতেও দ্বিধাবোধ করে না। কারণ আসলেই সে সুখী। অগণিত মানুষের ভালোবাসায় আজ সিক্ত সে। কিন্তু তবুও কোথাও একটা খালি খালি লাগে। জীবনে কী যেন নেই। কিসের যেন অভাববোধ বুকের ভিতরটা কুরে কুরে খায় প্রতিটা ক্ষণ।

অহনা তিন মাসের জন্য রাঙ্গামাটির পার্বত্য অঞ্চলের অসহায়, গরীব, অসামর্থ্য মানুষদের সেবা দিতে এসেছে আজ পঁচিশ দিন। এবং আশ্চর্যজনকভাবে আজ ওর পঁচিশতম জন্মদিন। আজ ঘুম থেকে উঠে সে পুরো সারপ্রাইজড হয়ে গেছে। মানুষগুলো তার জন্য বিশাল আয়োজন করে রেখেছে। কেউ কেক বানিয়ে এনেছে তো কেউ তার পছন্দের এটা সেটা রান্না করে এনেছে। তা দেখে সশব্দে কেঁদে ফেললো অহনা। এক প্রৌঢ়া এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
—“কাইন্দো না মা। এই খুশির দিনে কাঁনতে নাই। তোমার মা আসলেই ভাইগ্যবতী। তোমার মতো একটা রত্ন জন্ম দিছে।”

এমন আবেগঘন কথায় আরো কান্না পেয়ে গেল অহনার। চোখে পানি মুখে হাসি নিয়ে সবার সাথে খাবার ভাগবণ্টন করে তৃপ্তি সহকারে খেলো। অহনার মনে হলো বহুবছর হলো এমন পেটপুরে খাবার খায়নি সে। আজ পেটের সাথে সাথে মনও ভরে গেল। সবার সাথে আনন্দ করার ফাঁকে ফাঁকে রোগী দেখার কাজটাও সেরে ফেললো অহনা।

বিকেলবেলা অবসর সময়টা নিজের মতো কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল অহনা। উদ্দেশ্য রাঙ্গামাটির বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রিজে যাবে। ছোটোবেলা থেকেই শখ ছিল সেখানে একবার হলেও যাওয়ার। এখন যেহেতু সুযোগ পেয়েছে তাই হাতছাড়া করবে না। ঝুলন্ত ব্রিজে একাই আসলো গোধূলির সময়টা উপভোগ করতে। বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণ এই ঝুলন্ত ব্রিজ। ব্রিজটি কাপ্তাই লেকের উপর অবস্থিত। ব্রিজের দুইপার্শ্বে রেলিং দেওয়া। অহনা একপাশের রেলিং ধরে লেকের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। চোখ বন্ধ করে সময়টা উপভোগ করতে চাইলো। একটা প্রলম্বিত শ্বাস টেনে নিল ভিতরে। অতঃপর বিড়বিড় করে বললো

—“রহস্যময় মানব, আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার উসিলায়ই হয়তো আজ আমি এখানে। কিন্তু আজও পর্যন্ত আপনার দেখা পেলাম না। এতগুলো বছর মনে মনে কেবল আপনাকেই খুঁজে গেছি। রাস্তায় চলতে ফিরতে এদিক সেদিক চোখ বুলিয়েছি আপনাকে দেখার মিথ্যে আশায়। প্রতিবার ব্যর্থ হয়েছি আমি। তবুও খোঁজা বাদ দিইনি। আসলেই কি আপনি আছেন এই পৃথিবীতে? না-কি আমিই মিছে মরীচিকার পিছনে পাগলের মতো ছুটছি? আপনি তো বলেছিলেন কেউ একজন আমার প্রতীক্ষায় থাকবে। এই বয়সে আসার আগে যেন কাউকে ভালো না বাসি এটাও বলেছিলেন। জানেন, সেই অপেক্ষায় কাউকেই জীবনে জায়গা দিতে পারিনি। কেবলই মনে হতো কোথাও কেউ একজন আমার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু যে-ই আসতো মনে হতো এটা সে না যার অপেক্ষায় আমি আছি। তাহলে ‘সে’ কোথায়? কবে ধরা দেবে আমার কাছে? আমার অপেক্ষার পালা কবে শেষ হবে? সেই প্রতীক্ষমাণ ব্যক্তি কবে চক্ষুগোচরে আসবে? আদৌ আসবে তো!”

—“অবশেষে জীবনের আসল মানে খুঁজে পেলেন!”

আচমকা হৃদয় কাঁপানো এক পুরুষালী গম্ভীর কণ্ঠে অহনা বাস্তবিকই কেঁপে উঠলো। চোখ বন্ধ করেই হৃদয়ঙ্গম করলো এই কণ্ঠটা তার বহুল পরিচিত। শোনামাত্রই যেন প্রতিটি লোমকূপের উপক্রমণিকায় শিহরণ খেলে গেল। বুক কাঁপতে লাগলো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মতো অস্থিরভাবে। তাকাতেও কেন যেন ভয় লাগছে। কিন্তু তাকাতে যে হবেই। টলায়মান শরীরটা নিয়ে ঘুরে তাকালো তাঁর দিকে। দৃষ্টি নত করে এক হাতে রেলিং আঁকড়ে ধরে।

—“জীবন আসলেই খুব সুন্দর, তাই না?”

সাঁঝ বেলার রাঙা গোধূলির মনোরম আলোকসজ্জায় নেত্র তুলে তাঁর মুখের দিকে তাকালো অহনা। সেই কনে দেখা আলোয় সম্মুখে দাঁড়ানো সুপুরুষটাকে দেখে চোখের তারা জ্বলে উঠলো। ডেজা ভ্যু’তে চোখের সামনে ভেসে উঠলো এই ঐন্দ্রজালিক মুহূর্তের আকর্ষণীয় মানুষটার চেহারা। যুগপৎ হৃদয় ও সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো মাঘের হিমশীতল রাতের মতো থরথর করে। সে কি স্বপ্নে চলে গেছে? নয়তো এই মানুষটাকে এখানে দেখবে কীভাবে ও? মুখে সেই একই হাসি, শ্যামসুন্দর হৃদয়গ্রাহী চেহারার আকর্ষণীয় দেহাবয়ব, হৃদয় হরণ করা সেই নেশাযুক্ত কণ্ঠস্বর। সময় থমকে গেছে অহনার। চার চোখের শুভদৃষ্টিতে অগণিত মুহূর্ত পার হয়ে গেল। ছয় বছর আগে স্বপ্নে দেখা সেই সুপুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে! তার কি কিছু বলা উচিৎ না এখন? পূর্বের দুইটা প্রশ্নের জবাবে কী বলবে সে এখন?

সেই হৃদয়ে আটকে যাওয়া হাসিটা আবারও হাসলো শ্যামসুন্দর মানুষটা। মায়াঘোর বোধহয় ভাঙলো অবশেষে! অহনা সেই সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়েই মোহাবিষ্টের মতো বললো
—“অপেক্ষার পালা শেষ হতে আর কত দেরি?”

মানুষটা খানিকটা এগিয়ে এসে এক হাত দূরত্বে দাঁড়ালো। তাঁর ঐন্দ্রজালিক চাহনি অহনার টানা টানা হরিণী কৌতূহলী চোখে। সেই চোখে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে হাসলো আরেকটু। হালকা ঝুঁকে অবিচল কণ্ঠে আওড়ালো
—“যদি বলি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত!”

ললাট ও কপোলের একাংশে মানুষটার অবাধ নিঃশ্বাস পুড়িয়ে দিচ্ছে অহনাকে। চোখ তুলে তাকালো ঝুঁকে থাকা সুপুরুষের দিকে। চার চোখের ব্যবধান কয়েক ইঞ্চি মাত্র। অহনা সেই মোহনীয় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে স্থিরচিত্তে বললো
—“যদি বলি এই পর্যন্ত এসেই আমি হাঁপিয়ে গেছি! আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারবো না।”

হালকা করে ফুঁ দিল অহনার চোখেমুখে। চোখ বন্ধ করে ফেললো অহনা। ভিতরে কম্পনটা চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। কাঁপতে কাঁপতে অহনা আবারো বললো
—“সেই প্রতীক্ষমাণ ব্যক্তি কি এই মুহূর্তে আমার সামনে দাঁড়িয়ে?”

—“পৃথিবীর সবাইকে ঘৃণা করে নিজেকে শেষ করে দিতে চাওয়া সেই বোকা মেয়েটা আমার কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেই আজ এখানে বুঝি!”

হঠাৎ করেই যেন অহনার ঘোর কেটে গেল। মনে হলো সে এই মাত্রই বাস্তবিক দুনিয়ায় পদার্পণ করেছে। এতকাল যেন একটা ঘোরে থেকে জীবনযাপন করেছে। সেই ঘোর আচমকাই কাচের আয়নার মতো ঝনঝন শব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। চমকে উঠে আঁখি মেলে বললো
—“কে আপনি?”

লোকটা সোজা হয়ে চিত্তাকর্ষক হেসে বললো
—“প্রণভ মেহতাজ।”

অহনা সেই হাসির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো “দোহাই লাগে, এভাবে হাসবেন না প্রণভ। মর্ময*ন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি।।”

—“মিস অহনা তাবাস্সুম, আশা করি আপনার এই জীবনটা আগের জীবনের চাইতেও স্বস্তিদায়ক!”

—“কী বলছেন আপনি এসব?” বিস্ফোরিত চাহনি ও কণ্ঠস্বর অহনার।

—“আপনার তো জানার কথা। আপনিও কি প্রতীক্ষায় ছিলেন না আমার মতো?”

অহনা চমকে গিয়ে বললো
—“এর ব্যাখ্যা দিতে পারবেন আপনি?”

প্রণভ একপেশে হেসে অদূরে দৃষ্টি স্থির করে জবাব দেয়
—“পৃথিবীতে কি সবকিছুর ব্যাখ্যা হয় অহনা? এই যে আপনি এতগুলো বছর যাবৎ অপেক্ষা করে আছেন এক কাল্পনিক সত্ত্বার জন্য। সেটার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন আপনি? কেন অপেক্ষায় ছিলেন যাকে স্বচক্ষে কোনোদিন দেখেনইনি?”

—“আপনি এতকিছু কীভাবে জানেন?”

—“তাহলে আপনি বলছেন আমার জানার কথা নয়!” রহস্যময় হেসে বললো প্রণভ।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সেই মরা রংহীন আলোয় প্রণভের হাসিটা অহনার কাছে চমৎকার লাগলো। অবিশ্বাস্য গলায় বললো
—“কীভাবে সম্ভব এটা? কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। এই মিস্টেরিয়াস ঘটনার কী মানে? আর… আর ঐ… ঐ কথাটার কী মানে ছিল? এই বয়সে আসার আগ পর্যন্ত…?”

প্রণভ রহস্যময় হেসেই বলে
—“নভোমণ্ডলে শত সহস্র মিস্টেরিয়াস ইনসিডেন্ট ঘটে থাকে। সবকিছুর ব্যাখ্যা কি আপনার জানা? এমনকি সেসব জানতে ইচ্ছে করে? এখন তাহলে এত হাইপার হচ্ছেন কেন? ভেবে নিন না আপনার আমার সাথেও ঐরকমই কিছু ঘটে গেছে। এখন সেটা নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে ন্যাচার কি মেনে নেবে?”

প্রণভ কিছুকাল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে অহনার সুশ্রী মুখটা মন ভরে দেখে। অতঃপর বলে
—“আপনার প্রতীক্ষায় থাকা একজনের অপেক্ষায় আছেন না আপনি?”

অহনা চোখের পলক না ফেলে বলে
—“সেটা কি আপনিই?”

—“আমি হলে হতাশ হবেন?”

—“যদি হই?”

—“হতাশ হতে না করেছিলাম। তাহলে আসি আমি?”

অহনা চমকে উঠে বললো
—“আবার কোথায় যাবেন?”

প্রণভ অমায়িক হেসে শুধায়
—“আগেও গিয়েছিলাম বুঝি?”

অহনার বড়ো বড়ো চোখ দুটো স্বচ্ছ পানিতে টলমল করে উঠে। অভিমানী স্বরে বলে
—“আর কত অপেক্ষায় রাখবেন? আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই এবার হেরে যাব। কোনো পরিস্থিতিই মোকাবেলা করার চেষ্টা করবো না। কেউ একজন বলেছিল এই বয়সে আসার আগ পর্যন্ত কাউকে ভালো না বাসতে। সে আমার অপেক্ষায় থাকবে। তাঁর কথানুযায়ী আমি অপেক্ষায় ছিলাম। তাহলে আজ কেন এই ছলচাতুরী?”

প্রণভ মুক্তোঝরা হেসে ভ্রু উঁচিয়ে অহনার দিকে ঝুঁকে এসে বলে
—“আপনাকে কি আগে কেউ বলেছে কাঁদলে যে আপনাকে খুব এট্রাক্টিভ লাগে?”

অহনা টলটলে আঁখি ভর্তি অশ্রুকণা নিয়েই হেসে ফেলে দৃষ্টি নত করে। কপোলের তিল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ে সেই সুখাশ্রু। প্রণভের খুব ইচ্ছে করে তা আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু ছোঁয় না। মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে টপটপ করে তিল ছুঁয়ে চিবুকে গিয়ে জমায়িত হওয়া মুক্তোর ন্যায় অশ্রুবিন্দু।

________সমাপ্ত________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here